হঠাৎ করে মোবাইল ফোনের কলরেট বাড়ানোয় ক্ষুব্দ গ্রাহকরা
হুমায়ুন কবির খোকন ও সাব্বির আহমেদ: হঠাৎ করে মোবাইল ফোনের কলরেট ২৫ পয়সা থেকে ৪৫ পয়সা বাড়ানো একেবারে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন গ্রাহকরা। এ নিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কলরেট বাড়ানোর বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন না। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, এই বিষয়ে আগে বিটিআরসি’র সঙ্গে কথা বলেন। অনুমোদনের বিষয়ে পরে কথা হবে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রণালয় কলরেট বাড়ানোর ফাইলে অনুমোদন দেয়নি। এই বিষয়ে আমরা এখনো কিছু জানি না।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, এখন সর্বনিম্ন কল খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ পয়সা। এর সঙ্গে যোগ হবে ভ্যাট, ট্যাক্স। এই বাড়তি টাকা গ্রাহকদেরই দিতে হবে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নিয়ম অনুয়ায়ী কলরেটের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সীমা যথাক্রমে ৪৫ পয়সা ও ২ টাকা। গেল সোমবার রাত ১২টার পর ওই হার কার্যকর হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক মোবাইল অপারেটর গ্রাহকদের ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, পূর্ব কোনো ঘোষণা না দিয়েই অপারেটররা মোবাইল ফোনের কলের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা অন্যায়। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে যেকোনো ফোন কলের দাম কমার কথা সেখানে দেশে উল্টো ঘটনা ঘটছে।
মোবাইল অপারেটররা বলছেন, নতুন নির্ধারিত কলরেট অনুযায়ী গ্রাহকরা সুবিধা পাবেন বেশি। আগের তুলনায় কলরেটও কমছে। তবে গ্রাহকদের এ নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তারা বলছেন, আগে যেখানে ২৫ পয়সায় কথা বলা যেত এখন তা ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। এটা এক প্রকার জুলুম করা হয়েছে। গ্রাহকদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে দুই ধরনের কলরেট চালু আছে, অননেট ও অফনেট। অননেট হলো একই মোবাইল নেটওয়ার্কে কল করার (কথা বলার) পদ্ধতি এবং অফনেট কল হলো এক নেটওয়ার্ক থেকে অন্য নেটওয়ার্কে ফোন করা। নতুন নিয়মে এই অননেট ও অফনেটের কলরেট পদ্ধতি আর থাকছে না। কলরেট পরিবর্তনের নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকরের ফলে ছোট অপারেটর থেকে বড় অপারেটরে কল করার খরচ কমছে। যেমন টেলিটক থেকে গ্রামীণফোনে কল করতে এখন নূন্যতম খরচ ৬০ পয়সা। সেটি এখন কমে ৪৫ পয়সা হয়েছে। এতে গ্রাহকসংখ্যায় পিছিয়ে থাকা অপারেটররা তুলনামূলক বেশি সুবিধা পাচ্ছে। যদিও অফ-নেট কল থেকে ছোট অপারেটরদের আয় কমে যাচ্ছে। কারণ, এ ধরনের কলের জন্য ২২ পয়সা খরচ বাদ দিয়ে বাকি ৩৮ পয়সা এখন তারা পাচ্ছে। নতুন নিয়মে সে আয় কমে ২৩ পয়সা হয়।
বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট এ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, ‘যেকোনো নেটওয়ার্কে অভিন্ন রেট-এ কলের সরকারি সিদ্ধান্ত সামগ্রিকভাবে টেলিকম ভয়েস সেবার মূল্য নির্ধারণের জটিলতা কমেছে। পাশাপাশি গ্রাহকদের অধিক স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছে। এখন একজন গ্রাহক বাংলাদেশের ১৫ কোটিরও অধিক নম্বরে অভিন্ন রেটে কল করতে পারছেন, যা আগে সম্ভব ছিল না। এই সিদ্ধান্তের সুবিধা এমএনপি সেবা চালু হওয়ার পর সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা যাবে। একটি গ্রাহক-বান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলালিংক সবসময়ই গ্রাহকদের বাড়তি সেবা দিয়ে আসছে, এবং ভবিষ্যতেও এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
তবে মোবাইল ফোনের ‘কলরেট’ বাড়ানোয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ফেসবুকে গ্রুপ করে বিটিআরসির বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হচ্ছে। ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ঈদের পর কলরেট কমানোর আন্দোলনে ডাক দেবে। ইতোমধ্যে ফেসবুক গ্রুপে বলা হয়েছে, ‘বিটিআরসি অযাচিত কলরেট বৃদ্ধির প্রতিবাদে তিন দিন রিচার্জ বন্ধ রাখা, কলরেট ভ্যাটসহ ২৫ পয়সার মধ্যে চাই, তিন দিনের মধ্যে দাবি মানা না হলে সব মোবাইল গ্রাহককে তিন দিন সব মোবাইল বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতেও যদি সরকার প্রতিযোগিতামূলক কলরেট না করে তাহলে আন্দোলনে নামা হবে’।
গত শনিবার মোবাইল ফোনের ‘অযৌক্তিক কলরেট’ বাতিলের দাবি জানিয়েছে, বাংলাদেশ মোবাইল ফোন গ্রাহক এ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনায় নেয়নি। তারা অপারেটরদের স্বার্থে ভয়েস কলের ফ্লোর রেটের কলরেট ২৫ পয়সা থেকে ৪৫ পয়সা করেছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে তাদের গ্রাহকদের মতামত নেয়া উচিৎ ছিল।’ মহিউদ্দীন আহমেদ জানান, বর্তমান রেটে অপারেটর, আইসিএক্স+আইজডব্লিউ+এনটিটিএন’র ভ্যাট যোগ করলে কলরেট দাঁড়াবে প্রায় ৫২ পয়সা, যা আগের অফনেটের ফ্লোররেটের সমান।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, শুধুমাত্র অপারেটরদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লোকচক্ষুর অন্তরালে এই মূল্যবৃদ্ধি মেনে নেয়া যায় না।
মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, কলরেট বৃদ্ধির পক্ষে অ্যামটব একমত। কারণ, বাংলাদেশে ভয়েস কলের রেট বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। আর কলরেট বাড়লে তার বড় একটি অংশ পায় সরকার।
তবে কলরেট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কল রেট বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। আর মোবাইল ফোন অপারেটর ও সরকার টেলিযোগাযোগ খাত থেকে এখন যথেষ্ট আয় করে। তাই মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রাহকদের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বিটিআরসি ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) সহায়তায় প্রথম ভয়েস কলের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা বেঁধে দেয়। কলরেট নির্ধারণে সে সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটি ‘কস্ট মডেলিং’ করেছিল।