রোহিঙ্গা সংকটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে দ্রুত সমাধানের দাবি ব্যবসায়ীদের
স্বপ্না চক্রবর্তী: একবছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটি সেনাবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এতে করে দেশটির সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের যেমন অবনতি হয়েছে তেমনি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দুই দেশের অর্থনীতিতেও। এই ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কও ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তাই নয় রোহিঙ্গাদের পেছনে দেশের অর্থনীতিরও একটি বড় অংশ ব্যায় হয়ে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক পর্যালোচনায় বলা হয়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পেছনে বছরে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচের ধারণা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পক্ষ থেকে। তাদের দাবি এখন হয়তো বিশ্বের অনেক দেশই এগিয়ে আসছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট নিরসন না হলে বাংলাদেশকেই এর ব্যয়ভার বহন করতে হবে।
সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা সাত লাখেরও বেশি। বিপুল পরিমাণ এই জনগোষ্ঠীর থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসাসেবা দিতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার ব্যয় নির্বাহের জন্য ইতিমধ্যেই চালের দামের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দেশজুড়ে অস্থির হয়ে উঠেছে চালের বাজার। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, দীর্ঘমেয়াদী এবং অনিশ্চিত এই রোহিঙ্গা সংকট। এদের খাওয়া পড়ার যোগান দিতে ইতিমধ্যে চালের বাজারে একটা প্রভাব পড়েছে। শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির অস্থিরতাই নয় রোহিঙ্গা সংকটে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসায়ীদের মধ্যেও একটা ধারাবাহিকতার সংকট তৈরি হয়েছে।
এই রোহিঙ্গা সংকটে দেশটিতে রপ্তানিও কমেছে আগের বছরগুলোর তুলনায়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। অথচ আগের দুই অর্থবছরে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫৩ শতাংশের বেশি। রপ্তানি বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের মতে, মূলত গত নভেম্বর থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে ব্যবসা বাণিজ্যে। একই কারণে থমকে গেছে দুই দেশের মধ্যে বহু আকাক্সিক্ষত নৌ-প্রটোকল চুক্তিও।
ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ৩৮ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলার বা ৩০৫ কোটি টাকা সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ২৮ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত মিয়ানমারে পণ্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১৮ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার বা ৭৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা কম রপ্তানি হয়েছে, যা একই সময়ে আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪.৮৫ শতাংশ কম।
বিষয়টি নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এই সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে কতদিন থাকবে, তার কোনও ঠিক নেই। ভবিষ্যতে তারা যে স্বদেশে ফিরবে, এরও কোনও নিশ্চয়তা নেই। ফলে দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। তিনি বলেন, দুই লাখ ৩৩ হাজার রোহিঙ্গার দৈনন্দিন খরচের জন্য জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরে পক্ষ থেকে বছরে ১৩ দশমিক ৮ মিলিন ডলার বরাদ্দ থাকলেও তারা ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের বেশি পেতো না। অর্থাৎ বরাদ্দেরও প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ঘাটতি থাকতো। এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ায় এই হিসাবে এখন রোহিঙ্গাদের জন্য দৈনন্দিক খরচ মেটাতে প্রয়োজন ৩৭ মিলিয়ন ডলারের মতো। এছাড়া অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য প্রয়োজনে আরও অর্থ লাগবে।
তবে রোহিঙ্গা সংকটেও দেশটি থেকে চলতি বছর কোরবানির গরু আমদানী হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। তাদের সাথে খুব বেশি ব্যবসায়িক লেনদেন নেই বলে জানিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি শেখ সোবহান বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের জন্য মিয়ানমারে বাণিজ্য সম্প্রসারণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে অথচ পুরো বিশ্ব সুযোগটি লুফে নিচ্ছে। রোহিঙ্গা ইস্যুটি আমাদের জন্য ছিল মানবিক বিষয়। সারা বিশ্বও বিষয়টি সেভাবেই দেখছে। কিন্তু মিয়ানমার এই বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারছে না। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দুই দেশের আমদানি রপ্তানিতে। সরকারের উচিত দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে যত দ্রুত সম্ভব এই বিষয়টির সমাধান করে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেওয়া।