আমজনতার অর্থনীতি ডায়াবেটিক সেবায় জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সাধনা
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : ৬ সেপ্টেম্বর। মানবতাবাদি চিকিৎসক, স্বাস্থ্য-সমাজ সংগঠক, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের বাইশতম মৃত্যুবাষিকী। তার তিরোধান দিবসকে ‘সেবা দিবস’ হিসেবে পালনের মাধ্যমে তার সেবা দর্শনের পাঠ গ্রহণ এবং তার কর্মপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত ও অভিষিক্ত হওয়ার প্রত্যয় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির। সকল সৃজনশীলতায় এমন একটা ভাবদর্শন থাকে যা অয়োময় প্রত্যয় ও প্রতীতির নেপথ্য নায়ক হিসেবে অনির্বচনীয় ভূমিকা পালন করে। সেই বলিষ্ঠ বোধ ও বিশ্বাস, সেই অনুভব অনুপ্রেরণা সেই সুকৃতির সুষমা ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে আর ব্যষ্টি হয় সমষ্টির শক্তি। যে মহৎ কর্ম উদ্যোগ দেশ ও জাতির সীমানা পেরিয়ে মানব সমাজ ও সভ্যতার জন্য অনুপম আস্থা ও সেবার আদর্শ হিসেবে প্রতিভাত হয় তা আবার নিজ্ইে একটা ভাবাদর্শ নির্মাণ করে থাকে। জাতীয় অধ্যাপক ডা মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১১-১৯৮৯) এমন এক ভাবাদর্শের সাধক এবং উদগাতা যা বিশ একুশ শতকের বাংলাদেশে এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানবভাগ্যে আশির্বাদ হিসেবে বিবেচ্য। কৃতজ্ঞ দেশ ও জাতি এবছর এই মহান ব্যক্তিত্বোর জন্মশতবার্ষিকীতেও তাঁকে স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধায় ।
ডা. ইব্রাহিম কঠোর পরিশ্রমী, নিয়মানুবর্তী, উচ্চাকাঙ্খী, সৎব্যক্তি এবং কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। শিক্ষাজীবনে তার মেধা ও সাধনার মেলবন্ধনের ফলে অবজ্ঞাত, অনগ্রসর সমাজ ও পরিবেশ থেকে তিনি উঠে এসে ছিলেন সাফল্যের শিখরে। ১৯৩৮ সালে কলিকাতা মেডিকেল কলেজ হতে এম বি পাস করে চাকরিতে যোগ দিয়ে মাস তিনেকের মতো চক্ষু বিভাগে কাজ করার পরই কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রফেসর অব মেডিসিনের হাউজ ফিজিসিয়ানের পদটি পেয়ে যান তিনি। এই পদটির জন্য গৃহিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অধ্যাপক মনি দে তার প্রিয় ছাত্র ডা. ইব্রাহিমকেই নির্বাচন করেছিলেন। পূর্বে যে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান ডাক্তার ছিল তাদের কেউই এই পদটি পাননি। ডা. ইব্রাহিমই এই পদে প্রথম মুসলমান ডাক্তার ছিলেন। আর এই পদটি উচ্চাকাঙ্খী ডা. ইব্রাহিমের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এ সময়ে (১৯৩৮-৪৫) এবং পরবর্তী দুবছর (১৯৪৫-৪৭) কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান হিসেবে তিনি দেশব্যাপী নন্দিত প্রখ্যাত বিল্পবী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, অনন্ত সিং, ডিএন ধীরেন্দ্র মুখার্জী এবং সর্বভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ ব্যক্তি বর্গের চিকিৎসা সূত্রে সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাজ্য থেকে রেকর্ড পরিমাণ স্বল্পসময়ে এমআরসিপি, ১৯৫০ সালে আমেরিকান কলেজ অব চেস্ট ফিজিশিয়ানস এর এফসিসিপি, ১৯৬২ সালে পাকিস্তান কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এর এফসিপিএস , ১৯৬৭ সাালে রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস এর এফআরসিপি , ১৯৭৮ সালে রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস (গ্লাসগো ) এর এফআর সিপি ডিগ্রি অর্জন তার মেধা ও মুনশিয়ানার স্বীকৃতি । তিনি একাধারে দায়িত্বপালন করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এডিশনাল ফিজিশিয়ান এর এবং অধ্যাপনা করেন কলেজের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও মেডিসিন বিভাগে (১৯৫০-১৯৬২), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিনের অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ (১৯৬২-৬৪), করাচির জিন্নাহ স্নাতকোত্তর মেডিকেল সেন্টারের মেডিসিনের অধ্যাপক ও পরিচালক (১৯৬৪-৭১) এর পদে।
১৯৭৫-৭৭ সাল পর্যন্ত ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনিই প্রথম তদানীন্তন সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা প্রণয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং জাতীয় জনসংখ্যা কাউন্সিলকে পরিবার পরিকল্পনা নীতিমালা ও জাতীয় কার্যক্রম পরিচালনার নিয়ন্ত্রকের কার্যকর ভূমিকায় দাড় করান। তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে দেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে বহু কৌণিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে মৌলিক পরিবর্তন আনয়নে প্রয়াস পান। তিনি কেবল ডাক্তার বা পরিবার কল্যাণ কর্মীদেরই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে নিয়োজিত করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতেন না, বরং সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা, এমনকি আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেন। পরিবার পরিকল্পনাকে এই সম্পৃক্তকরণ (রহপষঁংরাবহবংং) কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশের সার্বিক উন্নয়নের গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করেন। এই মৌলিক পদ্ধতি প্রবর্তনের ফল স্বরূপ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণলয় ছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ, মহিলা বিষয়ক, শিক্ষা, শ্রম, ধর্ম বিষয়ক, যুব উন্নয়ন, তথ্য ও বেতার প্রভৃতি মন্ত্রণালয় ও বিভাগসহ বিভিন্ন এনজিওগুলোকে এই পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তার নীতিমালার মূল ভিত্তি ছিল উদ্বুদ্ধকরণ (সড়ঃরাধঃরড়হধষ) এবং শিক্ষাকার্যক্রম ছিল সরাসরি লক্ষ্যবস্তু ভিত্তিক (ঃধৎমবঃ ড়ৎরবহঃবফ) । তার সময়ই প্রথম সর্বাধিক পরিমাণ কর্মীকে পরিবার পরকল্পনা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে জেলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন এবং থানা হয়ে গ্রাম পর্যায়ে এ কার্যক্রম পরিব্যাপ্ত হয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন ভাবনায় ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের এই গভীর অন্তর্দৃষ্টি বিশ্লেষণে বলা যায় তিনি যদি উন্নত বিশ্বে জন্মাতেন তিনি বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন ও স্বীকৃতিলাভ করতেন । ডাক্তার ইব্রাহিম ঔড়যহ জঁংশরহ (৮ ঋবনৎঁধৎু ১৮১৯ – ২০ ঔধহঁধৎু ১৯০০) এর অর্থনৈতিক দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধাবলী টহঃড় ঞযরং খধংঃ (১৮৬০) বইটির ছাঁচে তার সমগ্র কর্মজীবন গড়ে নিয়েছিলেন, যে বইয়ে রাসকিন দেখিয়েছেন ‘অর্থ-বিত্ত মানুষের সত্যিকারের মূল্যায়ন করে না, মানুষের মূল্যায়ন হয় অন্য মানুষের তার উপর আস্থার ভিত্তিতে… একজন লোক ধনী কি নির্ধন সেটা নির্ধারিত হওয়া উচিত সেই লোকটির প্রতি অন্য কতজন লোকের আস্থা রয়েছে, সেটার ভিত্তিতে। যাকে দেখলে মানুষ আনন্দ হেসে উঠবে। মনে করবে তাদের পরম হিতৈষী চলে এসেছেন, এবার সকল সমস্যার সমাধান করে তাদের দুশ্চিন্তা মুক্ত করবেন তিনি। তাকে দেখা মাত্রই সবাই উল্লসিত মনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথ ছেড়ে দাঁড়াবে। অর্থাৎ মানুষের ভালোবাসা, সহযোগিতা এবং অবস্থাই ধনী-নির্ধন পার্থক্যের মাপকাঠি।’
রাসকিনের ভাবদর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তো বটে বিশ্বব্যাপি মহাত্মা নামে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন এবং খ্যাতি অর্জন করেন গান্ধীজী ১৯০৮ সালে গুজরাটি ভাষায় সর্বোদয়া শিরোনামে টহঃড় ঞযরং খধংঃ এর ভাবানুবাদ করেন। ডাঃ ইব্রাহিম গান্ধিজীর এই ধ্যানধারনাকে তার চিন্তাচেতনার চৌহদ্দীতে ঠাই দিয়েছিলেনÑ ‘কেউ যদি সর্বব্যাপী বিস্তুৃত চিরন্তন সত্যের মহত্বকে নিজের সম্মুখে বাস্তবে দেখতে চান তাহলে স্রষ্টার সৃষ্টিকে নিজের মতো করে ভালবাসার যোগ্যতা তার মধ্যে থাকতে হবে এবং এরূপ কাঙ্খিত ব্যক্তি এরপর জীবনের কোনো ক্ষেত্র থেকেই নিজেকে আলাদা করে রাখতে পারবে না। তাই সত্যের প্রতি এরূপ একাত্মতা আমাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে নিয়ে এসেছে, এবং আমি কোনো রূপ দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে বলা যায় সম্পূর্ণ বিনয়ের সঙ্গে বলছি যে যারা বলে রাজনীতিতে ধর্মের কোনো কিছুই করার নেই, ধর্ম কি বলছে তা তারা জানেন না।’
বাল্য জীবনে ডা. ইব্রাহিম যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন তা হলো বড় মানুষ হওয়া, বড় লোক হওয়া নয়। এই লক্ষ্য অর্জনে তার সাধনার প্রেরণার উৎস ঐতিহ্যবাহী পরিবারের আদর্শ, এই আদর্শকে চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য করে তুলতে তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন । সৎ, নির্ভিক, নির্লোভ, উচ্চাকাঙ্খী দৃঢ়চিত্ত মনোবলের জন্যই অজ পাড়াগাঁয়ের গন্ডি অতিক্রম করে কলকাতা এবং ঢাকার পথ পেরিয়ে বিশ্ব পরিক্রমায় বিশ্বের বৃহৎ বৃহৎ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছিলেন, দেশ-বিদেশের বৃহৎ সমাজে অত্যন্ত সুপরিচিত হয়ে খ্যাতির চূড়ায় আরোহন করেছিলেন তিনি। সর্বক্ষেত্রে মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছিলেন, কিন্তু কখনো নিজের ঐতিহ্যবাহী আদর্শ এবং লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎ হননি।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন করুণায়, মানবতায়, সেবায়, বলিষ্ঠতায়, দানে, ধ্যানে, ব্যক্তিত্বে এক বিরাট কর্মী পুরুষ। চিন্তায় স্থির, পরিকল্পনায় ধীর, কর্মে বীর তিনি ছিলেন সাধনা-পূর্ত জীবনের অধিকারী। একজন আদর্শবাদী স্বপ্নস্রষ্ট্ াএবং তার ছিল সাধনায় সিদ্ধি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তবমুখিতা ও কঠোর পরিশ্রমক্ষমতা। তার একটি অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলÑ যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন তাদের মধ্যে তিনি তার অফুরন্ত উৎসাহ উদ্যোম, অগাধ বিশ্বাস ও অসাধারণ কর্মশক্তির সামান্য হলেও কিছুটা সঞ্চারিত করে দিতে পারতেন। ফলে সরকারের ও সরকারের বাইরে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা পদে ও বৃত্তিতে যারা নিয়োজিত তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য ও সহযোগিতা তিনি সর্বদাই পেয়েছেন। তিনি একটি অটল আনুগত্য সম্পন্ন নিবেদিত প্রাণ কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মীগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
লেখক: সাবেক সচিব এবং এনবিআরের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সাবেক চীফ কো-অর্ডিনেটর