‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা’ একটি উপযুক্ত সমন্বিত পরিকল্পনা ও বিরাট সম্ভাবনা: ড. আতিউর রহমান
আশিক রহমান: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের বিভিন্ন সেক্টরে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা মোকাবিলা করার জন্য একটা কৌশগত পরিকল্পনাই হচ্ছে ‘ ডেল্টা প্ল্যান বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা’। এটা বিনিয়োগ পরিকল্পনাও বটে। কারণ ছয়টি হট স্পট নির্ধারণ করা হয়েছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনায়। উপকূল, নদী ভাঙনের মোহনার চড় এলাকা, নগর, বরেন্দ্র ভূমি ইত্যাদি। মূল কথা হচ্ছে যেসব জায়গায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খুব বড়ভাবে অনুভব করা যাচ্ছে। এসব হটস্পটে যে আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ডেল্টা প্ল্যানের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি একনেকে অনুমোদিত ‘ডেল্টা প্ল্যান বা ব-দ¦ীপ পরিকল্পনা’ সম্পর্কে এমনই মত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের।
এ প্রতিবেদককে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমাদের দেশের জন্য এটি একটি অভিনব। কারণ এর আগে কখনো এত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাংলাদেশ থেকে নেওয়া হয়নি। যদিও এই পরিকল্পনা কতগুলো সেগমেন্ট সময়ের মাইলস্টোন অনুযায়ী করা হয়েছে। যেমন ২০৩০, ২০৪০ বা ২০৮১ পর্যন্ত কতটুকু করা হবে তা বলা আছে। আর বাদবাকি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। আরেকটা জিনিস করা হয়েছেÑ প্রতি ৫ বছর পরপর এই পরিকল্পনাটাকে আপডেট করা হবে। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে এটি একটি লাইভ ডকুমেন্টারি া।
তিনি আরও বলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনার বড় গুণ হচ্ছেÑ এটা একটা টেকনিক্যাল, সোসিউ পলিটিক্যাল ও ইকোলজিক্যাল। একসঙ্গে অনেকগুলো জিনিস দেখা হচ্ছে। মূলত নেদারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগানোর চেষ্টা হয়েছে। নেদারল্যান্ড একটি ব-দ্বীপ। নেদারল্যান্ডকে পুরো ফোল্ডার করে ফেলেছে। আমরা কী করেছি, একটি অংশকে ফোল্ডার করেছি। অর্থ্যাৎ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে শুধু ফোল্ডার করেছি। নেদারল্যান্ড করতে পেরেছে, তাদের দেশ ছোট। অনেক বেশি অরগানাইজড তারা। লোকাল গভর্নমেন্ট খুব শক্ত। আমি নেদারল্যান্ডের ফোল্ডারগুলো দেখেছি কীভাবে তারা এটিকে বাস্তবায়ন করেছে।
ডেল্টা প্ল্যান বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা একটি খুব ভালো উদ্যোগ। কারণ বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘ একটা অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। বিশেষ করে বন্যার সঙ্গে বসবাস করা এবং একইসঙ্গে বন্যার যে ইতিবাচক দিকগুলো রয়েছে গ্রহণ করার একটি সংস্কৃতি এখানে গড়ে উঠেছে। সেটা হচ্ছেÑ নদীর সঙ্গে বাস করো, নদীকেও বাঁচতে দাও। সম্ভবত ২০ বছর আগে ফ্লাড প্ল্যান (বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা) নামে একটি পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। ফ্লাড প্ল্যান-১, ফ্লাড প্ল্যান-২ এরকম কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। আমিও একটি গ্রুপের সঙ্গে কাজ করেছি প্রকল্প পরিকল্পনার সময়। সেই সময় আমরা এই জিনিসগুলো আইডেনটিফাই করেছি। আইনুন নিশাত স্যারসহ অনেকেই তখন কাজ করেছি। নদীর স্বাভাবিক গতি বন্ধ না করে নদীকে নদীর মতো করে চলতে দাও। একইসঙ্গে নদীর যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেরকম কিছু স্ট্রাকচার যদি করা লাগে তা করা। আর নদীর সুবিধাগুলো গ্রহণ করা। ওই কনসেপ্টগুলো সম্ভবত কাজ করেছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. আতিউর রহমান বলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় দেশি-বিদেশি কনসালটেন্ট ছিলেন। ২৬শ বিশেষজ্ঞ কাজ করেছে এই পরিকল্পনার পেছনে, এমনটি জানতে পেরেছি। বিরাট একটা কাজ। সবচেয়ে বড় বিষয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব দিয়েছেন এই কাজটির পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা বড় গুণ, তিনি শুধু কাছেরটাই দেখতে পান না, তিনি অনেক দূরে দেখতে পান। কেন বলছি? আমরা যখন ২০০৮ সালে আমরা যখন কাজ করছিলাম, দিন বদলের সনদ যখন তিনি তৈরি করলেন, তখন তিনি একটি পরিবর্তনের কথা বলছিলেন যে, আগামীতে আমাদের সমাজ,অর্থনীতিতে একটা পরিবর্তন আসবে। সেই সময় তিনি প্রযুক্তির ব্যবহার, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আইডিয়াটা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তখন বললেন, মানুষকে আমার দরকার এবং প্রযুক্তিও প্রয়োজন আছে। ফলে এমন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যেখানে প্রযুক্তি থাকবে, একইসঙ্গে মানুষও কাজ করবে। তার পরপরই তিনি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন, যেটা ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত।
তিনি আরও বলেন, সমন্বিত পরিকল্পনার মাঝখানে আবার দুটি প্ল্যান দিলেÑপ্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাগুলোর আলোকেই ২০১৫-২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজি প্ল্যান করলেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এসডিজি প্ল্যান করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের এসডিজির গুণটা হলো, আমরা কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে পরিকল্পনাগুলো তৈরি করেছি। একটা ন্যাশনাল কমিটি হয়েছিল এসডিজির। সরকার, দেশীয় এনজিও, সিভিল সোসাইটি সকলে মিলে আলাপ করে পরিকল্পনাটা তৈরি করেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা বা আইডিয়াগুলো খুব গুরুত্ব দিয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় কৃষি আছে, শিল্প রয়েছে, পরিবেশ-প্রযুক্তিও আছে, মানুষও রয়েছে। এটা একটা সামগ্রিহক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রহণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার শিক্ষা ও লক্ষ্য প্রবন্ধে বলেছেন, যে একটি জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সে কতটা আশা করতে পারে। সে কতটা সুস্পষ্টভাবে ভাবতে পারে সে কোথায় আছে এবং কোথায় যাবে। এই ভাবনাগুলোর মধ্যেই একটি জাতির শক্তি নিহিত। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বড় গুণ তিনি ভবিষ্যতটা দেখতে পান। দেশকে আধুনিক করতে চাইলে একটি আধুনিক সমাজ দরকার। উন্নত দেশ করতে চাইলে একটি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। দেশের সবাইকে নিয়ে চলতে হলে বা অন্তর্ভুক্তি করতে চাইছি তাহলে কারণ দেশের দারিদ্র্যবিমোচন করতে হবে।
তিনি বলেন, ডেল্টা প্ল্যান একটা উপযুক্ত বড় সমন্বিত পরিকল্পনা। এর মধ্যে আমাদের বিভিন্ন খোপ বের করতে হবে। এই খোপগুলো বের করতে হলে আমাদের অনেক অর্থের প্রয়োজন। ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করবেন বলে উনারা পরিকল্পনা দিয়েছেন। আশিটি প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো গবেষণাধর্মী প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে যে জিনিসটি তারা করার চেষ্টা করেছেনÑ সব ডিসিপ্লিনকে একসঙ্গে আনার চেষ্টা করেছেন। ইঞ্জিনিয়াররা যেমন আছেন, ইকোনোমিস্টরাও রয়েছেন। সোস্যালজিস্টরা যেমন আছেন, রয়েছেন সাধারণ মানুষও। তবে ডেল্টা প্ল্যানের একটি দুর্বলতার কথা বলবÑ এটি বহুল আলোচিত নয় সেই অর্থে। সাধারণ মানুষ দলে দলে এর মধ্যে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। এটি মূলত কারিগরি পরিকল্পনা। এটা খুব খারাপ না। কারণ টেকনিশিয়ানরা টেকনিক্যাল প্ল্যান করবেন। ডেল্টা প্ল্যান যখন বাস্তবায়ন শুরু করবেন, আমার আহ্বান থাকবেÑ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার। কারণ আমাদের যে লুকায়িত জ্ঞান রয়েছে, আমাদের সমাজের দীর্ঘদিনের দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করার যে একটা অভিজ্ঞতা রয়েছে তা যেন আমরা বাস্তবায়নের সময় কাজে লাগাই। এর মধ্যে স্থানীয় পরিকল্পনাও থাকতে হবে। উপর থেকে চাপিয়ে দিলে হবে না। যেমন সিরাজগঞ্জ আর বাহাদুরাবাদের ইকোলজির সঙ্গে মেঘনার ইকোলজির সঙ্গে এক হবে না। মেঘনা আর সিরাজগঞ্জের নদীর ধর্ম এক হবে না। ফলে স্থানীয় বাস্তবতাগুলো মাথায় নিয়ে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আগামকে চিন্তা করে এর মধ্যে ফিটিং করা হচ্ছে অন্যান্য জিনিসগুলো। নদীর সভ্যতার যে উৎস সেটাকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে ব-দ্বীপ পরিকল্পনার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, একটি নদী যদি লোকালয় থেকে দূরে সরে চলে যায় তাহলে ওই লোকালয়ের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতাগুলো নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে। নদী যদি ধ্বংস করে দিই তাহলে সভ্যতাকেও আমরা ধ্বংস করি। আমাদের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বড় পরিকল্পনা যদি বলি তাহলে নদীগুলো বাঁচিয়ে রাখা বা জীবন্ত রাখা দরকার। আমাদের অনেক নদী মরে গেছে। মেরে ফেলেছি। অসচেতনতার জন্য আমরা আমাদের নদী-খাল-বিল মেরে ফেলছি। ডেল্টা প্ল্যান একটি দূরদর্শী পরিকল্পনা থেকে এসেছে। আমাদের নদী আর মারা যাবে না। নদীকে বাঁচিয়ে রেখে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে। এটা করতে গেলে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। নদীর ভাঙন রোধে দুই পাশে যে সমস্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার সেসব গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে এর সুফলটাও নিতে হবে। নদী থেকে যে মাটি তুলবে তা থেকে একটা নতুন ভূমি তৈরি হবে। সেখানে অনেককিছু আবাদ করতে পারব। অনেক স্থাপনা তৈরি করতে পারব। আমাদের যে ফোল্ডার রয়েছে তা পুনঃসংস্কার করা দরকার।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ড. আতিউর রহমান বলেন, আগামী দশ বা বিশ বছর পর হয়তো আমাদের সমুদ্রের পানি এতটাই বেড়ে যাবে ওই ফোল্ডার উপচে পানি চলে আসবে। এখন থেকে সেই ফোল্ডারটা উন্নত করতে হবে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা ওই পরিকল্পনাগুলো করতে হবে যে আগামী দশ বা বিশ বছর আমাদের কী ধরনের অবকাঠামো লাগবে। এখন যে রাস্তাগুলো আমরা করেছি সেসব তো পানির নিচে ডুবে যাবে। তাহলে রাস্তাটা তো আমাদের উপরে তুলতে হবে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা একটা লং টার্ম আমাদের গাইড লাইন হিসেবে কাজ করবে।
তিনি বলেন, পরিকল্পনা মাফিক যদি আমরা কাজ করতে পারি তাহলে দেড় শতাংশের মতো আমরা আমাদের গ্রোথ রেট বাড়াতে পারব। সেটাই দেওয়া ডেল্টা প্ল্যানে। এখন যদি সাড়ে সাত শতাংশ গ্রোথ রেট হয় ডেল্টা পরিকল্পনা যোগ করলে ৯ শতাংশ। সুতরাং এটা একটা বিরাট সম্ভাবনা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে অনেক কর্মসংস্থান হবে। অনেক প্রকল্প হাতে নিতে হবে। তবে চ্যালেঞ্জও আছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থ। বছরে যদি আমাদের কয়েক বিলিয়ন ডলার যুক্ত করতে হয় এই টাকা পাব কোথা থেকে? টাকা পাওয়ার একটাই উপায়Ñ জনগণকে কর দিতে হবে। নদীভিত্তিক যে ট্রেড অ্যান্ড কমার্স বাড়াতে হবে। আমরা আমাদের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সমস্ত পণ্য সড়ক পথে ট্রাকে পাঠাই। সেটা যে খরচ, তার ওয়ান থার্ড খরচ হবে যদি আমরা পণ্য পাঠাতে নদী পথ ব্যবহার করতে পারি। নদীপথে পণ্যগুলো পাঠালে তার থেকে যে রেভিনিউ আসবে সেই রেভিনিউর একটা অংশ এই পরিকল্পনায় আমরা ব্যবহার করব। এরকম চিন্তা আমরা করছি। ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের খরচের বড় একটা অংশ সরকার দিবে। তবে প্রাইভেট সেক্টরকেও এগিয়ে আসতে হবে। প্রাইভেট সেক্টর তার সামাজিক দায়িত্ব থেকে এই নদীগুলোকে উন্নত করার জন্য তাদেরও বিনিয়োগ করতে হবে। এখানে তাদেরও লাভ হবে। কারণ নদীভিত্তিক একটা সড়ক ব্যবস্থা যদি গড়ে উঠে তারাই তো সবচেয়ে বেশি লাভ পাবে