আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ৪
নিভে যাওয়ার পথে কবি আল মাহমুদ
জাফরুল আলম : কথা বলার শক্তি হারিয়েছেন কবি আল মাহমুদ। বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবি তিন মাস ধরে নির্জীব হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। কাউকে চিনতে পারেন না এখন। পাশে গিয়ে দাঁড়ালে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। ৮৪ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা যেন কোন অসুখে নন, বরং অনাদর আর অবহেলাতেই বুঝি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন। বাঙালি ও বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করে যিনি টগবগে দুর্দান্ত সব কবিতা লিখেছেন, আজ তার বড়ই দুর্দিন। নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছেন মগবাজারের বাসায়।
বেশ ক’বছর ধরেই তার শারীরিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু দু’চার জন ভক্ত আর স্বজন ছাড়া আর কেউ দেখতেও যাননি এই বরেণ্য কবিকে। সরকারের পক্ষ থেকেও এখনো কেউ খোঁজ নেয়নি, দেখতে যাননি কোন বিশিষ্টজন। এই কবি ও মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে একটিবারও দায়িত্বশীল কেউ উঁকি দেননি বড় মগবাজার ওয়ারলেস মোড়ের ‘গোমতী-আয়েশা’ ভিলায় কবির বাসায়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় কবির বড় ছেলে শরীফ মাহমুদের সাথে। তিনি বলেন, ‘আম্মা মারা গেছেন ২০০৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। তারপর থেকেই আব্বা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। গত তিন মাস ধরে বাকরুদ্ধ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন।’
আল মাহমুদের চিকিৎসা করছেন পারিবারিক চিকিৎসক, ইবনে সিনা হাসপাতালের নিউরো মেডিসিনের প্রফেসর আবদুল হাই। শরীফ মাহমুদ জানান, গত মাসে কবিকে চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়েছিলো। প্রফেসর হাই বলেছেন, বার্ধক্য ছাড়া তার শারীরিক তেমন কোন সমস্যা নেই। খাওয়া, দাওয়া ও শুশ্রুষার উপদেশ ছাড়া তেমন কোন ওষুধ দেননি।
কবিপুত্র বললেন, ’আব্বার শরীরের যে অবস্থা, তাতে উনাকে হাসপাতালে নিতেও সাহস পাচ্ছি না। বিছানায় শুয়েই দিনরাত কাটে তার। মাঝেমাঝে খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দেয়। সামান্য আহারেও অনীহা তার।’
কেউ খোঁজখবর নিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে শরীফ মাহমুদ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সরকার কিংবা বিশেষ কোন মহল বা ব্যক্তি আব্বাকে দেখতে আসেননি এবং কোন খোঁজও নেননি।’
সোনালী কাবিনের মতো কালজয়ী কবিতা তার সৃষ্টি। প্রেম এবং প্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন, লিখেছেন সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের পক্ষে। এক কবিতায় তিনি বলেছিলেন, তিনি কবিতার ভাষা বোঝেন। কবিতার জন্যে অনেকদূর পথ হেঁটে গেছেন। আজকাল কবিতা ছাড়া আর কোন স্বপ্ন দেখেন না।
লেখকের পাশাপাশি তার খ্যাতি আছে সাংবাদিক হিসেবে। তিনি ৭১ এর রণাঙ্গনের কাহিনী যেমন লিখেছেন, তেমনি দেশ বিভাগের করুণ অধ্যায় তুলে ধরেছেন নিজের উপন্যাসে। অথচ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বার্ধক্যে নুয়ে পড়া বিখ্যাত এই কবির খোঁজ নেবার সময় নেই কারো।
ডাক্তার বলছেন, বার্ধক্য তার একমাত্র সমস্যা, শরীরে আর কোন অসুখ নেই। আসলেই কি তাই? শরীরে রোগবালাইর কষ্ট নেই, এটা ঠিক। কিন্তু তার হৃদয়ে তো অনেক বড়ো এক ক্ষত বসবাস করছে অনেক বছর ধরেই। তাকে জামায়াতী বলা হয়। রাজাকার বলা হয়। অথচ একাত্তরের রণাঙ্গণের অসমসাহসী যোদ্ধা তিনি। যে হাতে কবিতার ফুল ফোটে, সে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য। আর তাকেই রাজাকার উপাধি দিয়েছে এই দেশের কিছু মানুষ। প্রিয়ডটকম-এ দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘দেখেন, আমি কোনোদিন এবং অতীতেও জামায়াতপন্থী ছিলাম না। এরা আমাকে জামায়াত বানিয়েছে এবং যারা বানিয়েছে, তারা তো দৈত্য বানিয়েছে। এখন দৈত্য তারা সামাল দিতে পারে না। জামাতী কাউকে আমি চিনতামই না। কিন্তু আমার যারা ক্ষতি করতে চেয়েছিলো, তারা এটা করেছিলো। আমার বলতে কোন দ্বিধা নাই, তারা কিন্তু নাই। আমি কিন্তু আছি। কারণ আমি তো সাহিত্য করি। আমি কবিতা লিখি, গল্প উপন্যাস লিখি। আমাকে তো গুলী করে মারা যায় না। গুলী করে মারলেও আমি সাহিত্যে থাকবো। না মারলেও থাকবো।’
যতোদিন কলম হাতে নিতে পেরেছেন, তার লেখা বন্ধ হয়নি। শারীরিক শক্তি ফুরানোর পর ডিকটেশন দিয়ে লিখাতেন, সাহায্য করতো তার নাতনি। এখন কবি কথাই বলতে পারেন না। থেমে গেছে তার সৃষ্টির দুরন্ত নদীর খর¯্রােত। জীবনের এই সায়াহ্ন বেলায় বাংলাদেশ কি তার খবর নেবে না? একটি বার কি মমতাভরে দাঁড়াবে না তার পাশে। বাকহীন কবির অপলক দৃষ্টি কি সেই কথাই বলছে আজ?