আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ৪
মুনাফা এবং অতিমুনাফা
বিভুরঞ্জন সরকার : বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী বলে একটি কথা চালু আছে । বাণিজ্য বা ব্যবসা না করলে লক্ষ্মী বা অর্থকড়ির মুখ দেখা যায় না। মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য করে লাভের আশায়। লাভ বা মুনাফার জন্যই ব্যবসা-বাণিজ্য। তবে ব্যবসা করলে আবার লাভ বা মুনাফার পাশাপাশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। সব ব্যবসায় সব সময় বড় অঙ্কের লাভ হয় না। এমন কি কখনো বা ক্ষতিও হয়। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতেও দেখা যায়।
ব্যবসাবুদ্ধি আবার সবার সমান হয় না। কেউ ব্যবসা করে কেবল সমৃদ্ধি বাড়ায় আবার কেউ কোনোভাবে টিকে থাকে বা জীবিকা নির্বাহ করে। মুনাফা এবং অতিমুনাফা বলে দুটি শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। আমাদের দেশে মুনাফার চেয়ে অতিমুনাফার দিকে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর বেশি ঝ্োঁক। ব্যবসায়ী মুনাফা করবেন না, সেটাতো হতে পারে না। মুনাফা না করলে ব্যবসা লাটে উঠবে বা ব্যবসায় লালবাতি চলবে। সেটা কেউ চান না। ব্যবসায় যুক্তিসঙ্গত মুনাফা না করাটা বোকামি। কিন্তু অতি মুনাফা?
‘অতি’ কোনো কিছুই ভালো নয়। আমাদের দেশে প্রচলিত প্রবাদে অতিবাড় না বাড়তে সতর্ক করে দেওয়া আছে। ‘অতিবাড় বেড়ো নাকো ঝড়ে পড়ে যাবে’- বলে সতর্কবাণী কবিকণ্ঠে আমরা শুনেছি। এসব আমরা শুনি কিন্তু মানি না। না মানলে যে খুব ক্ষতি হয় তা-ও নয়। যারা সাহস দেখিয়ে দাম বেশি হাঁকতে পারেন, সাফল্য তারই বেশি। আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রেই মাত্রাজ্ঞানের অভাব আছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। তাই মুনাফার চেয়ে অতি মুনাফা লাভের প্রবণতা অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য ছোট ব্যবসায়ীদের চেয়ে অতি মুনাফার লোভ বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বেশি। তারাই মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। ব্যবসা এবং রাজনীতি এখন একাকার হয়ে যাওয়ায় বাজার ব্যবস্থাটা আসলে কার নিয়ন্ত্রণে সেটা বলা মুশকিল।
আমরা আমাদের ছোট বেলায় কোনো ব্যবসায়ীকে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে দেখিনি। কিন্তু এখন কে ব্যবসায়ী আর কে রাজনীতিবিদ তার পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীও রাজনীতি করছেন, রাজনীতিকও ব্যবসা করছেন। ব্যবসার লক্ষ্য মুনাফা আর রাজনীতির লক্ষ্য জনকল্যাণ। মুনাফা এবং জনকল্যাণের সহাবস্থান হতে পারে, তবে সেটা সুখকর হতে পারে না। এর প্রমাণ কিন্তু বাজারে গেলেই দেখতে পাই। জিনিসপত্রের দামের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রতিদিনের খাওয়াপরায় যেসব জিনিস লাগে তার দামের ওঠানামা কেনো নিয়মনীতি মেনে চলে না। চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহ কোনো কারণে কম হলে তার দাম বাড়তে পারে। কিন্তু সরবরাহ কমেনি, চাহিদা বাড়ারও কোনো কারণ দেখা যায় না, অথচ বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে দেখা যায়। একেক বাজারে, এমনকি এক বাজারেও একই পণ্যের একাধিক দাম। ক্রেতা-ভোক্তারা অসহায়। তারা অসংগঠিত। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা সংগঠিত। তারা চাইলে পারেন না এমন কিছু নেই। জনগণ চাইলেও অনেক কিছু পারেন, কিন্তু আমাদের জনগণ ধৈর্যশীল। তারা অকারণ উত্তেজিত হয়ে কিছু ভাঙচুর করতে পারেন কিন্তু যেখানে ‘উত্তেজনা’ দেখালে তাদের সামষ্টিক স্বার্থ হাসিল হতে পারে, সেখানে তারা থাকেন নিরুত্তাপ!
আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে পাওয়ার আকাক্সক্ষা এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে তারা শুধু পেতেই চান। তারা সঙ্গীতশিল্পী হলে হয়তো কোরাস গাইতেন : দাও, মোরে আরো দাও!
মানুষের আর্থিক অবস্থা দিন দিন ভালো হচ্ছে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। দৈন্যদশা কমেছে। শিক্ষার হার বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবা একেবারে নাগালের বাইরে নয়। মানুষ সামগ্রিক বিবেচনায় হয়তো ভালোই আছে। কিছু অসাধু, অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী আঙ্গুল ফুলে দ্রুত কলাগাছ হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে অনেকের মনে, বিশেষ করে স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের জীবন অস্থির করে তুলছেন। তারা ভুলে যান, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে পেছনে ফেলে সংখ্যালঘিষ্ঠরা এগিয়ে গেলে পরিণাম ভালো হয় না। যাদের পেছনে ফেলে আপনি এগিয়ে যেতে চাইছেন তারা কিন্তু আপনাকেও পেছনেই টানবে!