জনগণের করের টাকায় দিবস উদযাপন
আবু তাহের খান : ১৯৮৫ সালের ২৬ জুন বিশ্বের ৫১টি দেশ সম্মিলিতভাবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার যে সনদে স্বাক্ষর করেন, সেটাই পরে কার্যকর হয় একই বছরের ২৪ অক্টোবর থেকে। আর তারই স্মরণে ১৯৪৮ সাল থেকে দিনটি (২৪ অক্টোবর) জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বস্তুত এটাই হচ্ছে দিবসকেন্দ্রিক উদযাপনের শুরু এবং যে দিনটি এখন জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সর্বত্রই অত্যন্ত মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়ে থাকে। পরে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থা কর্তৃক আরো বেশকিছু দিবসকে এভাবে উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে ইউনিসেফ-এর আওতাধীন আন্তর্জাতিক শিশু দিবস (২০ নভেম্বর), ইউনেস্কোর আওতাধীন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি) ইত্যাদি অন্যতম। দিবসকেন্দ্রিক উদযাপনের এ ধারা পুঁজিবাদী বিনিয়োগকারীদের চিন্তায় সহসাই মুনাফার নতুন সূত্র খুলে দেয়। জাতিসংঘের এসব দিবস উদযাপনের রীতিকে অনুসরণ করে এবং একইসঙ্গে মানুষের আবেগ ও হুজুগেপনাকে পুঁজি করে তারা তাদের নিজস্ব ঢং ও আদলে আরো বেশকিছু দিবসকে এ ধারার সাথে কৌশলে যুক্ত করে দিয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্বভালোবাসা দিবস, বিশ্বমা দিবস, বিশ্ববাবা দিবস ইত্যাদি। মানুষের কষ্ট, আনন্দ ও আবেগের অনুভবের পাখায় ভর করে এসব দিবস উদযাপনের রীতি ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিসটা জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের বিশ্বভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সে দেশে শুধু ফুল, জুয়েলারি, কার্ড ও চকলেট বাবদই ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সাথে আমোদপ্রমোদ, বিনোদন, ডেটিং, আহার, পানীয় ইত্যাদির ব্যয় যোগ করা হলে তা প্রায় শত বিলিয়ন ডলারকে স্পর্শ করবে বলে অনুমান করা চলে।
জাতিসংঘের আওতাধীন দিবসগুলো পালনের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী দেশগুলোতেও লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতার প্রাধান্য। এসব দিবস উদযাপনের কাজটি যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে হয়ে থাকে, সেহেতু সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো এ কাজটি যতোটা না অন্তর্গত তাগিদ থেকে করে, তারচেয়ে বেশি করে দায় সারাবার কিংবা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারপ্রচারণার প্রয়োজনে। ফলে এ ক্ষেত্রে যা হবার তাই হচ্ছে। দিবসটি পার হয়ে যাবার সাথে সাথে দিবস পালনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটুকুও হারিয়ে যেতে থাকে। আর এসব দিবস উদযাপনের প্রস্তুতিতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যা যা করা হয় এবং যে যে খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, সেসব নিয়েও প্রশ্ন তুলবার অবকাশ রয়েছে। জনগণের কষ্টার্জিত করের অর্থ এসব আয়োজনে যেভাবে ব্যয় করা হয়, তা আসলে জনগণের প্রকৃত স্বার্থকে খুব সামান্যই রক্ষা করতে পারে। বলা হতে পারে যে, এসব আয়োজনে ব্যয়িত অর্থের একটি বড় অংশই আসে উন্নয়ন সহযোগীদের দেয়া অনুদান থেকে, অতএব এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের প্রশ্ন আসে না। সেক্ষেত্রে বিনীতভাবে জানাই, উন্নয়ন সহযোগীরা যে অনুদান-সাহায্য দিয়ে থাকে, সেটাও আসলে সদস্য দেশসমূহের জনগণের কষ্টার্জিত করের পয়সায় পরিশোধিত চাঁদা থেকেই দেয়া হয়ে থাকে। আর অর্থ যে সূত্র থেকেই আসুক না কেন, মনে রাখা প্রয়োজন যে, সেটি এ বিশ্ব সম্প্রদায়েরই সম্পদ, যার হিস্যা এ দেশের জনগণেরও রয়েছে।
জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট দিবসগুলোর পালন প্রক্রিয়ার আরেকটি দুর্বলতার কথা এখানে না বললেই নয় এবং সেটি হচ্ছে, এসব দিবস পালনের আয়োজনসমূহ এখনও পর্যন্ত মূলতঃ শহরকেন্দ্রিক। গ্রামভিত্তিক সাধারণ মানুষ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা এসব দিবস পালনের মূল লক্ষ্য-জনগোষ্ঠী, তারা এসব আয়োজন থেকে বলতে গেলে বিচ্ছিন্নই থেকে যাচ্ছে। এঁদেরকে এ পালন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করতে না পারলে এসব দিবস পালনের আসল উদ্দেশ্যই অনর্জিত থেকে যেতে বাধ্য।
সবমিলিয়ে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে, জাতিসংঘকেন্দ্রিক দিবসগুলোর পালন প্রক্রিয়া অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা-প্রধান, লক্ষ্য-জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন এবং সেখানে অর্থের যথাযথ ব্যবহারের প্রশ্নটিও আসছে। অন্যদিকে, ব্যবসায়কেন্দ্রিক দিবসগুলোকে ঘিরে রয়েছে একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের ছড়াছড়ি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, দিবস পালনের অন্তর্গত দিকসমূহের ব্যাপারে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সাধারণ মানুষই প্রকৃত অর্থে সচেতন নন। আর এই অসচেতনতার কারণে একদিকে জাতিসংঘকেন্দ্রিক দিবসগুলো পালনের উদ্যোগ কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে এবং অন্যদিকে ব্যবসাকেন্দ্রিক দিবসগুলোর ক্ষেত্রে প্রকৃত মানবিক বোধ ও উপলব্ধিকে এড়িয়ে হুজুগেপনা ও ব্যবসায়ীদের মুনাফাই শুধু বাড়ছে।
লেখক : পরিচালক, ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
ধঃশযধহ৫৬@মসধরষ.পড়স