লুণ্ঠনের মাধ্যমেই বাংলাদেশে বেশিরভাগ ব্যাংকের উত্থান
ড. মইনুল ইসলাম : সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশের ধনকুবেরদের সংখ্যার বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির খবর সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, যা নাকি বিশে^ সর্বোচ্চ। ২০০১-২০০৫ ওই পাঁচ বছরে পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ^ চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেছিলো, আবার বাংলাদেশ বিশ^ চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করলো ধনকুবেরের সংখ্যাবৃদ্ধির দৌঁড়ে। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ এর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ধনকুবের ২৫৫ জন। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এদেশে যেভাবে নিজেদের আয় এবং ধনসম্পদ লুকোনোতে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করে থাকেন, তাতে হয়তো দেশে ধনকুবেরের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। অথচ, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে নাকি আবারো সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে! আমি বলব, ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ক্রমবর্ধমান প্রতাপের কারণেই গত ৪৩ বছর ধরে বাংলাদেশে এই ২৫৫ জন (বা আরো কয়েক’শ) রবার ব্যারনের উত্থান ঘটেছে। এই উত্থানের প্রধান প্রধান সিঁড়ির ভূমিকা পালন করেছে মূলত ৯টি প্রক্রিয়া। ১. ব্যাংকঋণের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, ২. বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর পুঁজি লুন্ঠন, ৩. সরকারের গৃহীত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ব্যয় অযৌক্তিভাবে অতিমূল্যায়নের মাধ্যমে পুঁজি লুন্ঠন, ৪. অস্বাভাবিকভাবে প্রকল্প বিলম্বিতকরণের মাধ্যমে পুঁজি লুন্ঠন, ৫. ব্যাংকের মালিকানার লাইসেন্স বাগানো এবং ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মাধ্যমে বাংকঋণ লুন্ঠন, ৬. প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ ও প্রাইভেট টেলিভিশন স্থাপনের ব্যবসা, ৭. শেয়ারবাজার কারচুপি ও জালিয়াতির মাধ্যমে পুঁজি লুন্ঠন, ৮. একচেটিয়ামূলক বিক্রেতার বাজারে (পড়ষষঁংরাব ড়ষরমড়ঢ়ড়ষু) যোগসাজশ ও দাম নিয়ন্ত্রণ এবং ৯. রিয়াল এস্টেট ব্যবসায়ে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও অত্যধিক দামবৃদ্ধি।
২ নভেম্বর ২০১৮ তারিখের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেলো, বাংলাদেশের ৫৯টি ব্যাংকের সাথে আরো তিনটি ব্যাংক চালু করার লাইসেন্স প্রদানের আয়োজন চলছে। মাত্র গত ২৯ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে পুলিশের মালিকানাধীন ৫৯তম ব্যাংক ‘কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ কার্যক্রম শুরু করার এক সপ্তাহ না যেতেই আরো তিনটি ব্যাংক লাইসেন্স পেতে চলেছে : পিপলস্ ব্যাংক, বেঙ্গল ব্যাংক এবং সিটিজেন ব্যাংক। এই তিনটি ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৬২টি। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সময় ৯টি ফার্স্ট জেনারেশন প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংক স্থাপনের অধ্যায় শুরু হয়েছিলো, ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের বেগম জিয়ার বিএনপি আমলে ১০টি সেকেন্ড জেনারেশন ব্যাংক লাইসেন্স পায়, আর ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৩টি থার্ড ও ফোর্থ জেনারেশন ব্যাংক চালু হয়। প্রতি আমলেই ক্ষমতাসীন দল বা জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়-স্বজন, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দল বা জোটের নেতৃবৃন্দ কিংবা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীরাই ব্যাংকের লাইসেন্স বাগাতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু, ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় বেগম জিয়া আবারো আরেক দফা নতুন কয়েকটি ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে চাইলে সেটা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, ব্যাংকের সংখ্যা অতিরিক্ত হয়ে গেছে, আর নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। বেগম জিয়া তাঁর অর্থমন্ত্রীর প্রতিরোধকে সম্মান জানিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
এমতবস্থায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদে আরো ১১টি ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদানকে অর্থমন্ত্রী মুহিত ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে’ অভিহিত করেও সরকারের প্রধানমন্ত্রীর জেদের কাছে নতি স্বীকার করছেন, বোঝাই যাচ্ছে। তাঁর নিজের মন্তব্য, ‘এভাবে অনুমোদনে আমি নিজেই অখুশি।’ কিছুদিন আগে এক সাবেক মন্ত্রীর ব্যাংকের এতবড় কেলেংকারির পর আবারো আরেক মন্ত্রীর মায়ের নামে ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে, নিশ্চয়ই তিনি খুশি নন। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর গত ৪৩ বছর ধরে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারই যে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ পূজারী তারই অকাট্য প্রমাণ হলো এই ব্যাংকের মালিকানা বন্টনের মচ্ছব, যেটা নিকৃষ্ট ধরনের রাজনৈতিক দুর্নীতি। আমাদের জানা আছে যে এই ব্যাংক-উদ্যোক্তাদের সিংহভাগই তাঁদের রাজনৈতিক কানেকশনের জোরে বা প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়তার পরিচয়ে কিংবা তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়ায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার সুবাদে বিনা মূলধনে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের অর্থে তাঁদের ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালক বনে গেছেন। মানে, তাঁর শেয়ারের জন্যে বিনিয়োজিত পুঁজিও ব্যাংকের অন্যান্য পরিচালক পরিশোধ করে দিয়েছেন। এই পরিচালকদের সিংহভাগ আবার দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, যাঁরা ব্যাংকের মালিকানা পেয়ে এদেশের ব্যাংক-ঋণের ওপর এক ধরনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করে ফেলেন। জাতীয় পার্টি, বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের সরকারগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের এহেন উদার পৃষ্ঠপোষকতার বারি কেন ব্যাংকের লাইসেন্স-প্রার্থীদের ওপর বর্ষিত হয়েছে তার রহস্য সবার জানা। বিনা মূলধনে কোটিপতি হওয়ার এতবড় যজ্ঞ অন্য কোনো দেশে চালু আছে কিনা আমার জানা নেই। ১৯৭৫ সালের পর গত ৪৩ বছরে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের রাজনীতিকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে গত ২৭ বছর ধরে ভোটে নির্বাচিত সরকারগুলো পালাক্রমে ক্ষমতাসীন হয়ে আসার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের মাধ্যমে রবার ব্যারন সৃষ্টিতে কোন ভাটার টান পরিদৃষ্ট হয়নি, যদিও হয়তো দলীয় রংবদল ঘটে চলেছে রবার ব্যারনদের।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়
সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব