প্রথম পাতা • মিনি কলাম • লিড ৪
ভবিষ্যতের ওষুধ শিল্প : বাংলাদেশ
আবু তাহের খান : কুইন্টিলস আইএমএস হোল্ডিংয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিলো প্রায় ৩৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ছিল ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ববাজারের মোট ওষুধ বিক্রির ১ শতাংশেরও কম (০.৬৫%)। অন্যদিকে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ২.২৭ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, যে পরিমাণ ওষুধ বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে, তা পৃথিবীর এ সংক্রান্ত বিক্রির তুলনায় অনেক পশ্চাৎবর্তী। অর্থাৎ বাংলাদেশে ওষুধের উৎপাদন এবং চিকিৎসাখাতে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ দুই-ই অনেক কম। আপাতদৃষ্টে এ পরিস্থিতিকে হতাশাব্যঞ্জক বলে মনে হলেও এখানেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প এবং চিকিৎসাখাতের উন্নয়ন ও বিকাশের অন্তর্গত সম্ভাবনাসমূহ।
বাংলাদেশে চিকিৎসাখাতে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ অনেক কমÑ এ কথার মানে হচ্ছে, সামর্থের অভাবে বাংলাদেশের মানুষ এ খাতে আরো বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারছে না। পাশাপাশি শিক্ষা-সচেতনতার অভাবে এ খাতে কম অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আশার কথা যে, এ দু’ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি ক্রমশ সামনের দিকে এগুচ্ছে, যা বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশের সম্ভাবনাকেই তুলে ধরে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষের আয় ও সঞ্চয় দুই-ই যেহেতু বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানে তার অর্থ ব্যয়ের সামর্থ বাড়ছে। আর এ সামর্থ বৃদ্ধির ফলে অন্যান্য পণ্য ক্রয়ের পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে সে ওষুধ ক্রয়ের জন্যও বাড়তি অর্থ ব্যয় করবে বলে আশা করা যায়; যার ফলে ওষুধের চাহিদা বাড়বে এবং সে সূত্র ধরে বাড়বে ওষুধের উৎপাদনও। অন্যদিকে, শিক্ষা-সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে চিকিৎসাখাতে অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ বাড়বে এবং সেটিও ওষুধের চাহিদা ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। মোটকথা, আসন্ন দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজের অভ্যন্তরীণ বিকাশের ধারা বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত ও ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা যায়।
এবার আসা যাক ওষধের আন্তর্জাতিক বাজার ও উৎপাদন পরিস্থিতির বিষয়ে। পৃথিবীতে চিকিৎসা-সুবিধা এবং চিকিৎসার জন্য অর্থ ব্যয়ের প্রবণতা যে হারে বাড়ছে, তাতে ধারণা করা যায় যে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গড় হারের তুলনায় সেটি অনেক দূর এগিয়ে থাকবে। আইএমএফ-এর করা হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ সনে বিশ্বঅর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.১ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে বিশ্ববাজারে ওষুধ বিক্রি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১.১১ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে বাংলাদেশে অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিলো ৭.২৬ শতাংশ এবং এর বিপরীতে ওষুধ শিল্পখাতে উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিলো প্রায় ১২ শতাংশ। অর্থাৎ ওষুধের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক চাহিদা ও উৎপাদনের প্রবণতা পর্যালোচান্তে প্রতীয়মান হয় যে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই নিকট ভবিষ্যতের দিনগুলোতে বাংলাদেশী ওষুধের ব্যাপক বাজার চাহিদা ও সুবিধা রয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, এ সুবিধাকে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে? এরমধ্যে একটি সুবিধার কথা অনেকেই জানেন। ট্রিপস (ঞৎধফব জবষধঃবফ অংঢ়বপঃং ড়ভ ওহঃবষষবপঃঁধষ চৎড়ঢ়বৎঃু জরমযঃ—ঞজওচঝ) চুক্তির আওতায় ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য শুষ্ক রেয়াত সুবিধা প্রদানের মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। বস্তুতঃ এ সুবিধার আওতাতেই বাংলাদেশের ৩০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখন ১১৩টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে দেশের সংখ্যা উৎসাহব্যঞ্জক হলেও এরমধ্যে অনেকগুলো দেশেই রপ্তানির পরিমাণ এখনও অত্যন্ত নগণ্য। কোম্পানিগুলোর উচিৎ হবে রপ্তানির এ পরিমাণ বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হওয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে উৎপাদনরত ওষুধ কারখানার সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১৫০টি। তন্মধ্যে মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ আসে মাত্র ২০টি কারখানা থেকে। এ অবস্থায় ছোট পরিসরের ১৩০টি কারখানার উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যায় কিংবা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা আরো বাড়ানো যায় কিনা, সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে। পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান চাহিদা, বিশেষত আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা বিবেচনা করে বড় কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারে।
অনেক দিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে যে, রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশকে পোশাকখাতের উপর মূল নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য খাত থেকেও রপ্তানি বৃদ্ধির প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। অধিকাংশের মত হচ্ছে, পোশাক খাতের বাইরে ওষুধই হতে পারে বাংলাদেশে নিকট ভবিষ্যতের বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পোশাকখাতের আরো একটি বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ এই যে, এর কাঁচামাল (বস্ত্র ও অন্যান্য) আমদানির হিসাব বাদ দিলে এ খাতে মূল্য সংযোজন বা এ খাত থেকে প্রকৃত রপ্তানি আয়ের পরিমাণ খ্বুই কম। সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ওষুধ শিল্পখাতের অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি পরিহারের একটি সুযোগ এখন বাংলাদেশের সামনে রয়েছে এবং সেটি হচ্ছে যে, ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য সম্প্রতি একটি এপিআই (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়্যান্স) শিল্পপার্ক স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এটি যাতে দ্রুত উৎপাদনে যায়, সে ব্যাপারে আনুষঙ্গিক তৎপরতা আরো জোরদার হওয়া প্রয়োজন। তবে ঘটনা হচ্ছে যে, এপিআই শিল্পপার্কে স্থাপিতব্য সবগুলো কারখানা উৎপাদনে যাওয়ার পরও বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতার হিসাবেই আরো ৫০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। ফলে এপিআই শিল্পপার্কে স্থাপিতব্য কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা যতোটা বাড়িয়ে করা যাবে, উৎপাদনের জন্য কাঁচামালের আমদানি-নির্ভরতাও ততোটাই হ্রাস পাবে।
এবারে ওষুধ কারখানাগুলোর পরিচালন বিষয়ে খানিকটা আলোকপাত করা যেতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরল প্রযুক্তির শিল্পেও বহু সংখ্যক বিদেশি কাজ করা সত্বেও আশার কথা যে, দেশের ওষুধ শিল্প-কারখানাগুলো এখনো স্থানীয় জনবলের দক্ষতার উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হচ্ছে এবং এটি নিঃসন্দেহে একটি গৌরবের বিষয়। তবে নিকট ভবিষ্যতের অধিকতর প্রযুক্তিঘন ও অতি উন্নত মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনের অপরিহার্যতার কথা চিন্তা করে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফার্মেসিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আওতাধীন পাঠ্যক্রমকে যতোটা সম্ভব আধুনিক চাহিদার সাথে ঢেলে সাজাবার ব্যাপারে উদ্যোগী হবে বলেই আশা রাখি।
বাংলাদেশ থেকে এখন রোগীরা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। কিন্তু দেশের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনাকে সিঙ্গাপুরের মতো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে তোলা গেলে বিদেশিরাও এখানে চিকিৎসা নিতে আসবেন। আর সে বিষয়টি বাংলাদেশের দ্রুত বিকাশমান ওষুধ শিল্পখাতকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করতে পারে। হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা গেলে তা শুধু হাসপাতালগুলোকেই বর্ধিত আয়ের সংস্থান করে দেবে না, এ সুবাধে বাংলাদেশে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজারও ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করা যায়।
সবমিলিয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা শিল্পখাতের নিকট ভবিষ্যতের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে ওষুধ শিল্প, যার রপ্তানি সম্ভাবনা বর্তমানের তৈরি পোশাক শিল্পকে অচিরেই ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। তবে সে যাত্রায় শুধু আয় ও মুনাফা বৃদ্ধিকে মূল বিবেচনায় না রেখে এটিকে একটি আন্তর্জাতিক মানের খাত হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে সচে??? হওয়া প্রয়োজন, যেখানে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ওষুধের গুণগত মান, কার্য-পরিবেশের সুরক্ষা ও সন্তোষজনক শিল্পসম্পর্ক পরিস্থিতি বিরাজমান থাকবে। লেখক : পরিচালক (সিডিসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ধঃশযধহ৫৬@মসধরষ.পড়স সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব