উচ্চতর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে বাণিজ্যব্যবস্থার সহজীকরণ
আবু তাহের খান : অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে পারার কারণে অর্থনীতির আন্তর্জাতিক আলোচনায় বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গই এখন গুরুত্বের সঙ্গে ওঠে আসছে। আর এসব আলোচিত প্রসঙ্গের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ এবং শিক্ষিত তরুণদের বর্ধিত সংখ্যায় চাকরি বহির্ভূত পেশায় যুক্ত হওয়ায় মতো ইতিবাচক দিকগুলো যেমন রয়েছে, তেমনি আবার রয়েছে দক্ষতার সাথে শিল্প ও ব্যবসায় পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার মতো নেতিবাচক অনুষঙ্গগুলোও। বলা হচ্ছে যে, শেষোক্ত এ প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করা সম্ভব হলে কিংবা নিদেনপক্ষে তা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বর্তমানের বার্ষিক ৬-৭ শতাংশের বলয় অতিক্রম করে সহসাই দু’অঙ্কের স্তরে পৌঁছে যেতে পারবে বলে আশা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু শিল্প ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতাসমূহের বিস্তারিত আলোচনা একটি দীর্ঘ পরিসরের বিষয়। তাই এখানে বস্তুতঃ বাংলাদেশের বাণিজ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রক্রিয়াগত জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিয়ে অতি সংক্ষেপে খানিকটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হলো।
দেশের ব্যবসায় ও অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর উপরোক্ত প্রবণতা সম্পর্কে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত একটি সাধারণ মূল্যায়ন এই যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে হারে ও ধারায় বিকশিত হচ্ছে, এর প্রকৃত বিকাশমানতার সম্ভাবনা তারচেয়ে অনেক বেশি। সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর নানা অন্তর্গত দুর্বলতার কারণে এ বিকাশ অহরহই নানাভাবেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাগুলো বিনষ্টও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটি যেহেতু সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর মৌল চরিত্রের আমূল পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত, সেহেতু রাতারাতি এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আশা করা যায় না। ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষে পরিচালিত গণতন্ত্রের ধারাবাহিক চর্চাই কেবল সেটিকে সম্ভব করে তুলতে পারে, যার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামোর আওতাতেই প্রচলিত বিধিবিধান ও নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সংস্কারমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে এ চলতি সময়েই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারাকে আরো অনেকখানি ত্বরান্বিত করা সম্ভব। আর যেসব ক্ষেত্রে একেবারে কালবিলম্ব না করে জরুরি ভিত্তিতে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন, তার একটি হচ্ছে দেশের প্রচলিত বাণিজ্যব্যবস্থার সহজীকরণ ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে একে সাধারণের স্বার্থের অনুগামী করে তোলা।
বাংলাদেশের প্রচলিত বাণিজ্যব্যবস্থার সহজীকরণের লক্ষ্যে এর নানা বিধিবিধান ও নিয়মকানুনের ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন এ ক্ষেত্রে প্রতিপালনীয় বা অনুসরণীয় আইন, বিধিবিধান ও আনুষঙ্গিক নিয়মকানুন সম্বলিত বিজ্ঞপ্তি ও প্রজ্ঞাপনসমূহের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা। বিষয়টির সাথে একাধিক মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর ও সংস্থা জড়িত বিধায় কাজটি অনেকটাই কঠিন বৈকি! তবে এ কঠিন কাজটি পূর্ণাঙ্গভাবে করা সম্ভব হলে তা শুধু বাণিজ্য সহজীকরণের জন্যই নয়Ñ আরো বহুবিধ কাজের ক্ষেত্রেই তা গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক উপাত্ত ভিত্তি (ডাটা বেইজ) হিসেবে কাজে আসবে বলে আশা করা যায়।
উল্লিখিত বিজ্ঞপ্তি ও প্রজ্ঞাপনসমূহের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি হয়ে যাবার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হবে এগুলোকে অনুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে এসবের মধ্যকার দ্বন্ধ, বিরোধ, অসামঞ্জস্য ও অপূর্ণাঙ্গতাসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলো দূরীকরণের লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণ। আর তা করতে যেয়ে হয়তো দেখা যাবে যে, বহু ক্ষেত্রে এসব আইন, বিধিবিধান ও নিয়মকানুন সংক্রান্ত আদেশ, বিজ্ঞপ্তি ও প্রজ্ঞাপনের অনেকগুলোই সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হচ্ছে এবং কোনো কোনোটি হয়তো বাতিল করারও প্রয়োজন হতে পারে। তদুপরি এসব ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গতা আনয়ন বা অসামঞ্জস্যতা দূরীকরণের লক্ষ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আবার নতুন করে প্রণয়ন ও জারি করারও প্রয়োজন হতে পারে।
উপরোক্ত বিষয়টি বস্তুতঃ কাগজ-কলমে লিপিবদ্ধকরণের ব্যাপার এবং কষ্টসাধ্য হলেও একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যেই হয়তো তা করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু সমস্যার বড় অংশ বিরাজমান রয়েছে অন্যত্র এবং সে অন্য অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে : ১) সমুদ্র ও স্থল বন্দরসমূহের অপর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধাদি এবং সেসবের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা; ২) অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে অতি দুর্বল রেল, সড়ক ও নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা; ৩) বন্দর ও পরিবহন ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত লোকবলের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত অদক্ষতা; ৪) বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আচরণ ও সম্পর্ক গড়ে তুলতে না পারা ইত্যাদি।
স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় একেবারে প্রথমেই আসতে পারে দেশের বাণিজ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় আইন-কানুন, বিধিবিধান ও অন্যান্য বাধ্যবাধকতাসমূহের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা। প্রস্তাবিত এ তালিকার আবার দু’টি ভাগ থাকতে পারে : এক. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য স্থানীয় বিধিবিধান; এবং দুই. বৈদেশিক বাণিজ্যের সাথে সম্পাদিত স্থানীয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের বিধানাবলী। এ কাজটি করার লক্ষ্যে সম্প্রতি গঠিত ন্যাশনাল ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কমিটি (এনটিএফসি)-এর পক্ষ থেকে দেশের সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নিকট চিঠি লিখে এতদ্সংক্রান্ত তালিকা প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধিবিধানের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। আর আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রফতানি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশের বিধিবিধান সম্বলিত তালিকার জন্য সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিএ), জাতিসংঘ বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড), বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের। আর এ কাজে এনটিএফসিকে বিশেষভাবে সমন্বয়মূলক সহযোগিতা প্রদান করতে পারে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক।
বন্দর ও পরিবহন ব্যবস্থা এবং আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নয়নে স্ট্যাকহোল্ডারদের কাছ থেকে মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের উপরোক্ত প্রস্তাবটির গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখেই এ প্রসঙ্গে এখানে অতি সংক্ষেপে ছোট্ট কয়েকটি মন্তব্য তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি। বলা প্রয়োজন যে, দেশের দু’টি সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলার বিপুল বাণিজ্য সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ দু’টির কোনোটিরই অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতার স্তর আর্ন্তজাতিক মানদ-ে প্রথম দিকেতো নয়ইÑ মাঝামাঝি পর্যায়েও নেই। তদুপরি মংলা বন্দরের স্থাপিত সামর্থের সিংহভাগই আবার অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। অথচ ঘটনা হচ্ছে যে, এ দুটি বন্দরকে পরিপূর্ণ দক্ষতার সাথে পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যবহার করা গেলে বাংলাদেশের নিজস্ব আমদানি-রফতানি বাণিজ্যই- যে শুধু বাড়তি গতিশীলতা খুঁজে পাবে, তাই নয়। এ বন্দর দু’টির সেবা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানের কাছে বিক্রি করে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ারও সুযোগ রয়েছে। আর ঐ দেশ তিনটিকে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুযোগদানের বিষয়টিকে বাংলাদেশ তাদের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনের দর কষাকষিতেও চমৎকার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে বলে মনে করি।
অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রেলপথকে কাক্সিক্ষত মাত্রায় ব্যবহার করতে না পারার বা না করার ব্যর্থতা। চট্টগ্রাম ও মংলা উভয় বন্দর থেকেই রেলযোগে দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনের সুযোগ থাকলেও সেটি কাক্সিক্ষত মাত্রায় হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে যে, এর সাথে সড়ক পরিবহন মালিক ও ব্যবসায়ীদের অস্বচ্ছ গোপন যোগসাজশ ও কারসাজি রয়েছে। অবশ্য রেলের ব্যাপারে এটাই একমাত্র অভিযোগ নয়। রেলের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি ও অদক্ষতা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি রয়েছে রাষ্টের অঙ্গীকারাবদ্ধ নীতিগত সমর্থন। বাণিজ্যব্যবস্থায় বর্ধিত গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে রেলযোগে সহজে ও তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়ে পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করতে হলে এই নীতিগত সমর্থন শুরু জরুরিই নয়— বস্তুতঃ এর কোনো বিকল্পও নেই।
বলা হচ্ছে যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ খুবই ভালো করছে। এ ক্ষেত্রে আরো দু’টি অভিমত যুক্ত করা যেতে পারে, যার একটি হচ্ছে এই যে : বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে গতিতে সামনের দিকে এগুচ্ছে, এ ক্ষেত্রে প্রকৃত সম্ভাবনা তারচেয়েও অনেক বেশি। অতএব সে সম্ভাবনাগুলোকে দ্রুত চিহ্নিত করে এসবের সমাধানপূর্বক এগুতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই আরো বহু ক্ষেত্রে বিশ্বঅর্থনীতির রেফারেন্স হিসেবে গণ্য হতে পারবে। দ্বিতীয়ত: দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে যেসব কাঠামোগত ত্রুটি ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে যদি সেগুলো অর্ধাংশও দূর করা সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার আগামী এক দশকের মধ্যে অন্ততঃ ২ থেকে ৩ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে আশা করা যায়। আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার এই কাঠামোগত ত্রুটি ও প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের তালিকায় সর্বাগ্রেই আসতে পারে বাণিজ্যব্যবস্থা সহজীকরণের বিষয়টি। আর সম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটি করা সম্ভব হলে (যা করতে না পারার কোনোই কারণ নেই), তা শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারকেই উঁচুতে নিয়ে যাবে নাÑ দেশের অর্থনীতির উপযোগকে এর সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুগামী করে তুলতেও সহায়ক হবে। জবাবদিহিতাপূর্ণ দায়িত্বশীল সংস্কার ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনেও বাণিজ্যব্যবস্থার গণমুখী রূপান্তর অনেকাংশেই সম্ভব বলে মনে করি। লেখক : পরিচালক (সিডিসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ধঃশযধহ৫৬@মসধরষ.পড়স. সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব