বিশেষ সাক্ষাৎকারে ত্রিপুরার বিশিষ্ট কবি শঙ্খ আদিত্য পল্লব ত্রিপুরার প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে
মুক্তিযুদ্ধে ভারত
প্রিয়াংকা আচার্য্য : শঙ্খ আদিত্য পল্লব ত্রিপুরার বিশিষ্ট কবি। মুক্তিযুদ্ধে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি গঠন করেছিলেন। জন্ম বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)। লেখাপড়া করেছেন ঢাকায়। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে এসে আক্ষেপ রয়েই গেছে। বাংলাদেশের প্রতি বরাবরই লালন করেন অখ- ভালোবাসা। ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আগরতলায় তার বাড়িতে বসেই শুনলাম সেই ভালোবাসার কথা।
৭১ সালে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল ১৪ লাখের বেশি। যা ছিল ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সকলেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে। এমন একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না যার অংশগ্রহণ ছিল না। এমন একটি বাড়ি পাওয়া যাবে না যেখানে পরিচিত বা অপরিচিত শরণার্থীরা আশ্রয় নেয়নি।
সেসময় কংগ্রেস ক্ষমতায়। কেন্দ্রীয় সরকার ও ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ বাংলাদেশিদের দিকে সাহায্যের উদার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া প্রাথমিকভাবে সিপিএমের নেতাকর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছেন। পরে দলীয়ভাবে কেন্দ্রের নির্দেশ আসার পর তারা একযোগে আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমি তখন শিক্ষকতা করতাম। লেখালিখিসহ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমার বন্ধু বিশ্বদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করলাম মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে সহায়তা করতে পারি। এরই প্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি গঠন করা হলো। বর্তমানে যেখানে কামান চৌমুহুনী অবস্থিত সেখানে আমরা প্রথমবার বাংলাদেশের পক্ষে পথ সভা করলাম। ধীরে ধীরে এ জনসভার পরিধি বাড়তে লাগলো। ত্রিপুরার প্রত্যেক সংস্কৃতিকর্মী বিভিন্ন সময়ে এ সভায় তখন যোগ দিয়েছিলেন।
ড. আনিসুজ্জামানসহ অনেকেই তখন আগরতলায়। ড. আনিসুজ্জামানকে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির ২৫ বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমি ও কল্যাণব্রত চক্রবর্তী নিয়ে এসেছিলাম। উনার বক্তৃতায় তখন অনেকেই উজ্জীবিত হয়েছিল।
তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ নির্মল সেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মতো নেতাদেরও প্রথম আশ্রয় ছিল আগরতলা। পরবর্তীতে সুযোগ মতো তারা কলকাতায় চলে যান। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল।
এছাড়া আমি আর সত্য বাবু মিলে তখন ‘সন্দীপ থেকে ধলেশ্বরী’ নামে একটা কাগজ বের করা শুরু করি। দুই বাংলার কবি সাহিত্যিকরা সেখানে লেখা দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এর দুটি সংখ্যা বের হয়েছিল। রণেশ দাসগুপ্ত, সৈয়দ শামসুল হকসহ পূর্ব বাংলার অনেকেই সেখানে লিখেছেন।
এছাড়া বাংলাদেশ থেকে কবি অরুণাভ সরকার আগরতলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি দুটি ছোট কাগজ এখান থেকে বের করতেন। আমি আর কল্যাণ চক্রবর্তী অরুণাভকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা করেছি।
সেসময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হতো। সেখানে আমার প্রাণের বন্ধু জিয়া উদ্দিন কামালের সাথে দেখা হয়। কামালের বাড়ি ফেনির নিমতলীতে। সে ছিল বেলাল চৌধুরীর ছোট ভাই। বহুদিন পর তাকে দেখার পর আমি আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে যাই। এরপর সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে তার সাথে পরে আর আমার দেখা হয়নি। যাওয়ার আগে আমি তার কম্বল রেখে আমার মায়ের হাতে সেলাই করা কাঁথা তাকে দিয়েছলাম।
মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকা শক্তি বলে আমি মনে করি তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। সেই বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত তরুণদের বাঙালি জাগরণের আন্দোলনে অংশগ্রহণ। আমি এখানে শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, শেখ মণির মতো তরুণ ছাত্র নেতাদের দেখেছি। আমি তখন প্রত্যক্ষভাবে কোনো সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও ত্রিপুরার সব সাংবাদিকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। বিশেষত সাংবাদিক অনীল ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি তখন দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক অমৃতবাজার ও দি হিন্দুর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এছাড়া শরৎচন্দ্র, তারাপদ ব্যানার্জী ছিলেন। তারা পূর্ব বাংলা থেকে আগত নেতাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর অতি দ্রুত পাকিস্তানি সেনারা পিছু হঠতে শুরু করে। জেনারেল মানেকশয়ের পরিকল্পিত আক্রমণ পাকিস্তানিদের নাজেহাল করে ছাড়ে। সকলের অংশগ্রহণেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।