বিশেষ সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক পবিত্র সরকার ভারতের সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নেয়
প্রিয়াংকা আচার্য্য : প্রবীণ সাংবাদিক পবিত্র সরকার। জন্ম ফরিদপুরের সদর মহকুমার টুকুনদিয়া গ্রামে। ১৯৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ার সময়ই যোগ দেন কালান্তর পত্রিকায়। রাজনৈতিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) সমর্থন করেন। দেশ বিভাগের সময় খুব ছোট থাকায় জীবনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা মনে করেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে। তিনি ও তার পরিবারের পূর্ণ সমর্থন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। ২০১৬ সালের ৯ জুন কলকাতায় তার বাড়িতে বসেই শুনলাম মুক্তিযুদ্ধের কথা।
আপনারা জানেন, একেবারে প্রথমদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দ্বিধায় ছিল। তাদের ২৪তম কংগ্রেসেও এ সম্পর্কে কোনো প্রস্তাব সরাসরি গ্রহণ করা হয়নি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি তখনও স্বাধীনতার এ আন্দোলনে সমর্থন দিতে দ্বিধাবোধ করছিল। পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই নেতা ভবানী সেন নিজে ব্যক্তিগতভাবে সোভিয়েত নেতাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দানের ব্যাপারে কথা বলতেন।
এছাড়া সিপিআই নেতা ভূপেষ গুপ্ত, রাজেশ্বর রাও, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিলেও অনেক কমিউনিস্ট নেতাই শুরুতে বিরোধিতা করেন। আমি পার্ক সার্কাসে দেখেছি বড় বড় হরফে লেখা ছিল ‘ইন্দিরা-ইয়াহিয়া এক হ্যাঁয়’ এমন আরও অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত দেয়ালিকা। সেসময় ক্যামেরা এখনকার মতো সহজলভ্য না থাকায় এগুলো ধারণ করা সম্ভব হয়নি। যদিও এখন কেউ এসব স্বীকার করবে না। তাদের অফিসিয়াল স্ট্যান্ডও ছিল এমন যে, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করার কৌশল নিচ্ছে।
এর কারণ তখন কংগ্রেস ক্ষমতায় এবং তারা মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ সমর্থন করছে। কংগ্রেসের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ছিল তীব্র সংঘাত। তাই এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেই প্রথমদিকে দুঃখজনকভাবে এ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলিম এবং এখানে বসবাসকারী বিহারের অধিকাংশ মুসলিমও প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন করেনি। পরে বাস্তব অবস্থা উপলব্ধির পর তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয় আর তারা মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করে। কিন্তু ইতিহাস তো নির্মম। কারও ভুল তো সে ক্ষমা করে না।
এটাই সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ভারত সরকার একনিষ্ঠ চেষ্টা এবং এখানকার কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক শক্তির দৃঢ় সমর্থন ও হস্তক্ষেপে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলো তাদের অবস্থান বদল করে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়।
৭১ সালে এই দৈনিক কালান্তরের দপ্তরটি যেন মুক্তিযুদ্ধের থার্ড ফ্রন্টে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক রাজনীতিকদের দেখতাম সেখানে। দেখেছি রাজপথের অগ্নিঝরা নেত্রী মতিয়া চৌধুরীকেও। আমি কালান্তরে নিয়মিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখতাম। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদসহ সকল নেতারা এ কাগজটি গুরুত্বের সাথে পড়তেন।
তখন মধ্য কলকাতার লেবুতলা এলাকায় আমরা থাকতাম। বাংলাদেশ ছাত্র যুব শরণার্থী ও দুঃস্থ ত্রাণ কমিটি নামে একটি কমিটি করেছিলাম। আগস্ট মাসে প্রাচী হলে এ কমিটির অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সুচিত্রা মিত্র ও সানজীদা খাতুন গান এবং কাজী সব্যসাচী আবৃত্তি করেছিলেন। ‘হেডমাস্টার’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করা হয়েছিল। গোটা হলভর্তি থাকায় প্রচুর টাকা উঠেছিল। সব টাকাই আমরা বাংলাদেশের কল্যাণে ব্যয় করি।
নভেম্বর মাসের দিকে এই কমিটিই স্থায়ী একটা সংগঠনে রূপ নেয় ‘জন সহায়ক সমিতি’ নামে। সেখানে তরুণ সান্যাল, ভূপেন্দ্র কুমার দেসহ অনেকে জড়িত ছিলেন।
এছাড়া তারশংকর বন্দোপাধ্যায়কে সভাপতি ও দীপেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে সাধারণ সম্পাদক করে দুই বাংলার শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে সিপিআই একটি সংগঠন গড়ে তোলে। এ দলের কর্মীরা গান গেয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করতো। সেখানে বাংলাদেশের গায়করাও যোগ দিতো।
সল্টলেকে সেসময় আজকের এই ঝলমলে শহর ছিল না। সেখানে ছাউনিপাতা শরণার্থী শিবিরে হাজার হাজার বাংলাদেশির আশ্রয় ছিল। সরকারের পাশাপাশি সিপিআইয়ের নেতাকর্মীরা সকল রাজ্য থেকে ত্রাণ তুলে সেখানে সহায়তা করেছিল।
ভারতে শুধু পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা শুধু নয় ব্যাঙ্গালোর, বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) বা দিল্লির মতো বড় বড় রাজ্য থেকেও অনেকে সাহায্য করেছে। অনেক ছোট ছোট শহর ও সম্প্রদায়ের মানুষ অর্থদানসহ নানাভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। যা ভারতের সামগ্রিক ইনভল্বমেন্টের পরিচয় বহন করে। অথচ তাদের সেসব কন্ট্রিবিউশনের কথা এখন আমরা প্রায় জানি না বা উল্লেখ করি না।