পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট অধ্যাপক ধ্রুব জ্যোতি লাহিড়ী বাংকারে বাংকারে নারীদের অসংখ্য ছেঁড়া পোশাক দেখেছি
মুক্তিযুদ্ধে ভারত
প্রিয়াংকা আচার্য্য : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিজ দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ করে জনমত গঠন করতে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ধ্রুব জ্যোতি লাহিড়ী সক্রিয় ভূমিকা পলন করেছেন। শরণার্থীদের জন্য ত্রান সংগ্রহ ও তা দেয়ার জন্য ছুটেছেন সীমান্ত এলাকাগুলোতে। বাংলাদেশে থেকে আগত লেখক-শিক্ষকদের জড়ো করছেন, তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে তার অসমান্য অবদানের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করেছেন। ২০১৬ সালে ১১ জুন তার সল্টলেকের বাড়িতে বসে কথা হলো মুক্তিযুদ্ধে তার স্মৃতি নিয়ে ৭১ সালের একটা স্মৃতি এখনও আমাকে তাড়া করে ফেরে। শত্রুমুক্ত হওয়ার পর আমরা কুষ্টিয়ার ভেতরে যাই। সেখানে যা দেখি তাতে আমরা চমকে যাই। প্রত্যেকটি বাংকারে বাংকারে বিপুল পরিমাণে নারীদের পোশাক। ফাঁসির দড়ি থেকে শুরু করে এখানে-সেখানে ছিটা ছিটা রক্ত। অত্যাচারের মাত্রা কিরূপ হলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে তা দেখে আমরা শিউরে উঠেছি।
মার্চের শেষ দিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের ওপর অতর্কিত আক্রমণের পর আমরা বুঝতে পারলাম ঘটনার ব্যাপকতা। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির সিনেট সদস্য দিলীপ চক্রবর্তীর ডাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষদের নিয়ে গঠিত হলো ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’। তখন শিক্ষক আন্দোলনে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তারা এ সংগঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেন। দিলীপ চক্রবর্তী সেক্রেটারির দায়িত্ব নিলেন। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের সামর্থ অনুযায়ী পূর্ব বাংলায় হওয়া হত্যাযজ্ঞসহ নির্যাতন নিপীড়নের কথা এখানকার মানুষদের জানাতে লাগলাম। আমরা কি কি উপায়ে তাদের সহায়তা দিতে পারি তা ঠিক করতে লাগলাম। তবে যেকোনো পদক্ষেপের বাস্তবায়নেই টাকা লাগে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি আমাদের ১০ হাজার টাকা দিল। দিলীপ চক্রবর্তীসহ সংগঠনের সকলেই বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অর্থ সংগ্রহ করা শুরু করলাম।
এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা প্রথমদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। আমাদের চেষ্টা ছিল তাদের পক্ষে আনা। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে লাখ লাখ শরণার্থী আসা শুরু করেছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের যথাসম্ভব সহযোগিতা করবো। পূর্ব বাংলা থেকে আসা লেখক-শিক্ষকসহ অনেকেই ধীরে ধীরে আমাদের সাথে যোগ দেয়া শুরু করলেন। অধিকাংশরাই প্রায় কর্পদকশূন্যভাবে চলে এসেছিলেন। আমরা তাদের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে চেষ্টা করতাম। লেখকদের সাথে এখানকার প্রকাশকদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। ড. আনিসুজ্জামান, ড. অজয় রায়সহ আগত সকল শিক্ষকদের বলা হলো, যার যার মতো ডকুমেন্টেশন তৈরি করতে।
আমাদের সংগঠন লক্ষেèৗ, বিহারসহ দেশের সকল উল্লেখ্যযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিটিং করে, চিঠি বা ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। এসব যোগাযোগে আমাদের ছাত্র-শিক্ষকসহ বাংলাদেশ থেকে আগতদের সহায়তা সবচেয়ে বেশি নেয়া হতো। বাংলাদেশের শিক্ষকদের নিয়ে একটা সংগঠন করতেও আমরা সহায়তা করেছি। এদিকে আমরা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেসব অত্যাচারের তথ্য পাঠাতে লাগলাম। সেখান থেকে এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভাবনীয় প্রতিক্রিয়া আসতে। একে একে বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন আসতে লাগলেন। আমরা তাদের সাথে অপার থেকে আসা নির্যাতিতদের পরিচয় করিয়ে দিতাম। তারা তাদের সাক্ষাৎকার শুনতো, ছবি তুলতো। এভাবে তারাও ডকুমেন্টগুলো তাদের দেশে নিয়ে সেসব ছড়িয়ে দিতে লাগলো।
সীমান্ত এলাকাসহ তখন সল্টলেকেও শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছিল। আমরা সীমান্তের ওপারে গিয়েও যতোটা পেরেছি ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছি। জুতা জামা থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য প্রচুর ত্রাণসামগ্রীর প্রয়োজন দিন দিন বাড়তে লাগলো। সীমান্ত এলাকাগুলোতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কয়েকটি হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল। সেখানেও আমরা ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দিতাম।
এদিকে আমরা রিলিফ দেয়ার সময় সীমান্তে গেলে বাংলাদেশের ভেতরে ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার যতদূর যাওয়া যায় গিয়ে দেখে আসতাম। অস্ত্র না থাকায় মিলিটারিরা আমাদের আটকাতো না। সীমান্ত থেকে নিরাপদ ৬-৭ এবং পশ্চিবঙ্গের ভেতরে প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত সকল স্কুলগুলি মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। আমরা সেসকল স্কুলের শিক্ষদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে কাজ করতাম। এছাড়া সেখানে বাচ্চারা আছে তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল ৫-৬ মাসব্যাপি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র আসা শুরু হলো। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের কমিউনিকেশন ইন্সট্রুমেন্ট তৈরি করে দেয়া হলো।
ইন্দিরা গান্ধীর গ্লোরিয়াস রোল গোটা সময়জুড়ে ছিল। সরকারি সহায়তাই শিবিরগুলির মূল ত্রাণ ছিল। তাদের সাথে আমরাসহ আরও অনেক সংগঠন সহায়ক হিসেবে পাশাপাশি কাজ করে গেছে। ত্রাণ সামগ্রী দিতে গিয়ে আমরা অনেক মানবিক সমস্যার মুখোমুখি হতাম। দেখা গেলো, এক জায়গায় ৫০ জনের জন্য শীতের কাপড় নিয়ে গেছি। সেখানে একজন বেশি আছে। যে পায়নি তার মুখের দিকে তাকানো যেতো না। শীতকাল সকলেরই গরম কাপড় দরকার। কারণ ওপার থেকে অধিকাংশ লোকই বলতে গেলে এক কাপড়ে চলে এসেছিলো। যাই হোক, যিনি বাদ পড়েছেন তাকে আমাদেরই একজন তার নিজের কাপড়টি খুলে দিয়ে বলেছেন যে পরের বার আসার সময় তার জন্য কাপড় নিয়ে আসবেন। পরে গেলে তাকে আর পাওয়া যায়নি। সেই ছেলে যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। এমন অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী আমরা।