আব্দুল কুদ্দুস : সবজিতেই জীবন
বিভুরঞ্জন সরকার : কতোদিন থেকে তাকে সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় সবজি বিক্রি করতে দেখছি ঠিক মনে নেই। তবে বছর দশকের কম নয়। তিনি ১৪ বছর ধরে সবজি বিক্রি করেন। বলা চলে সবজিতেই তার জীবন বাধা পড়েছে। তার নাম আব্দুল কুদ্দুস। কীভাবে সবজি বিক্রেতা হলেন? না, পেছনে কোনো বড় কাহিনী নেই। কাহিনী সাধারণ। জীবন বাঁচাতে একটা কিছু করার জন্য গ্রাম থেকে ঢাকা এসে চাকরি-বাকরির চেষ্টা করেছেন। পাননি। তারপর স্বাধীন ব্যবসা করার কথা মাথায় আসে। তবে বড় কিছু করার কথা ভাবেননি, মাথায়ও আসেনি। জীবনটা কোনোভাবে চলে যায় সেটাই ছিলো ভাবনার কেন্দ্রে।
গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুরে। ২৮ বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষণে ঢাকা আসেন। কিছুটা লেখাপড়া করেছেন। তবে কোনো সার্টিফিকেট নেই। একজন বাঙালি কবি কবিতা লিখেছিলেন, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়! কুদ্দুসও ভরা যৌবনেই জীবনযুদ্ধে অংশ নিতে ঢাকা আসেন। যুদ্ধ এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামে থাকতে শুনতেন, ঢাকার আকাশে টাকা ওড়ে। ঢাকা এসে উড়তে থাকা টাকা টপাটপ ধরতে পারবেন বলে মনে করতেন। কিন্তু এসে দেখেন, ঢাকায়ও টাকা রোজগার সহজ নয়। বেঁচে থাকার সংগ্রাম এখানেও কঠিন। তবে গ্রামে চেষ্টা করেও কাজ পাওয়া যেতো না, ঢাকায় পরিশ্রম করলে জীবন বাঁচানো যায়।
সবজি বেচে সংসার বা জীবন চলতে পারে এটা কীভাবে বুঝলেন? এই প্রশ্নের জবাবে আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ক্যামনে ক্যামনে যে সবজির ডালি মাথায় নিলাম, তা বলা কঠিন। তবে এখন আর পিছন ফিরে চাই না।
শুরুতে কারওয়ান বাজার থেকে পাইকারি দামে সবজি কিনে বিক্রি করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে নিয়ে। প্রথমে মাথায় করেই বহন করতেন। তারপর একটি ভ্যান ভাড়া নিয়েছিলেন। দুই বছরের মধ্যে নিজেই একটি ভ্যান কিনেছেন। এখন তিনি নিজের ভ্যানেই মালামাল আনা-নেয়া করেন। কতো আয় হয় প্রতিদিন? আব্দুল কুদ্দুস জানালেন, প্রতিদিন তার আয় পাঁচশ টাকার কম নয়। কোনো কোনো দিন একটু বেশিও হয়।
খুব যে আরাম-আয়েশে জীবন কাটে তা নয়। ঢাকায় তিনি একাই থাকেন। তিন পুত্র সন্তান নিয়ে তার স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। বড় ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মেঝো ছেলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ছোট ছেলের বয়স দুই বছর। পরিবারের সদস্যদের দূরে রেখে ভালো লাগে না। কিন্তু যে আয় করেন তাতে সবাইকে নিয়ে মন চাইলেও ঢাকায় থাকা সম্ভব হয় না। তবে যখনই মন খারাপ হয় তখনই বাড়ি ছুটে যান। দুই ঈদে অবশ্যই বাড়ি যান। ‘বাড়ি গেলে সময়টা সবার সঙ্গে আনন্দেই কাটে। স্ত্রীর ইচ্ছা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার। কিন্তু আমার সামর্থ্যরে কথা ভেবে চাপাচাপি করে না। বউ আমার বড্ড ভালো মেয়ে। সেজন্যই এমন ছাড়া ছাড়া থেকেও আমাদের সংসারের বন্ধনটা মজবুত আছে’ বলে একটি সলজ্জ হাসি হাসেন কুদ্দুস।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে কুদ্দুস বলেন, বর্তমান নিয়েই হিমশিম খাই। ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবি কখন? তবে ছেলে তিনটাকে লেখাপড়া শিখাতে চাই। ওরা যদি মানুষ হয় কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে কুদ্দুসের।
ভোটের সময় বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা কুদ্দুসের। তিনি গ্রামেই ভোটার হয়েছেন। ভোট দিতে চান ধানের শীষে। কারণ জানতে চাইলে বলেন, এই সরকার দশ বছর ধরে আছে। এবার একটু বদল হওয়া দরকার। এক দল বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা ভালো না বলে মনে করেন তিনি। তবে ভোট দিতে পারবেন কিনা তা নিয়েও তার সংশয় আছে। কারণ মানুষের মুখে যেসব আলোচনা শোনেন তা থেকে তার মনে হয়, ভোটের দিন গোলোযোগ হতে পারে। নিজে বিএনপিকে ভোট দিতে চাইলেও শেখ হাসিনারই আবার ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা বেশি বলে তিনি মনে করেন।
তাকে নিয়ে পত্রিকায় কিছু লেখা হবে শুনে কুদ্দুস বললেন, আমাদের কথা লিখে আর কি হবে। পত্রিকায় সব চোর-বাটপারদের কথা দিয়ে বোঝাই। খারাপ মানুষরাই এখন সবচেয়ে সম্মানি। টাকা থাকলে এখন মান-সম্মানও কিনতে পাওয়া যায়। পেছনে যাকে গালাগাল দেই, সামনে তার কতো প্রশংসা করি।
মানুষের মধ্যে সুবিধাবাদী প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন সবজি বিক্রেতা কুদ্দুস। একজন জীবনসংগ্রামী মানুষ, কষ্ট করছেন, রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সবজির ভ্যান ঠেলছেন জীবনের চাকাটাকে সচল রাখার জন্যই।