আগরতলার বিশিষ্ট নাট্যজন সুভাষ দাস ত্রিপুরার বাঙালি-উপজাতী সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল
প্রিয়াংকা আচার্য্য : ত্রিপুরার বিশিষ্ট নাট্যজন সুভাস দাস ১৯৭১ সালে কলেজে শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মার্চের শেষ সপ্তাহে আগরতলায় মশাল মিছিলের যাত্রী ছিলেন। শরণার্থীদের আশ্রয়ে নিজ হাতে ঘর তুলেছেন। আরও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত থাকার কথা শোনালেন ২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে আগরতলায় তার বাড়িতে বসে।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিবেশী দেশের মুক্তি সংগ্রামে অন্য দেশের এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ঘটনা বিরল। এখানকার অধিকাংশ নাগরিকের পূর্ব পুরুষ বাংলাদেশের হওয়ায় নাড়ীর টান থেকেই আন্তরিকভাবে তারা র্পূব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ত্রিপুরা রাজ্যে গণতন্ত্রের পক্ষে শিক্ষার জন্য লড়াই করা উপজাতি গণমুক্তি পরিষদও বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের নেতা প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেব প্রবলভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিলেন। ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেকোনো কাজ চালাতে গেলে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সহায়তা ছাড়া তা করা অসম্ভব। বাঙালি-উপজাতি সকলে শ্রেণী-বর্ণের মানুষ মনে প্রাণে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। যার ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ত্রিপুরার সর্বত্র নির্বিঘেœ-নিশ্চিন্তে পাহাড়ে-খন্দরে ঘাঁটি গেড়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে পেরেছিল। ত্রিপুরার দুই অংশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকায় যা সম্ভব হয়েছে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দানবীয় গণহত্যা পরিচালনার ঘটনা শুনতে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি। আমরা শিক্ষার্থীরা এমন নিপীড়ণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের সাহস-সহমর্মিতা জানানোর জন্য কলেজ টিলা থেকে আলোর মিছিল বের করে সীমান্তে গিয়েছিলাম।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে লোকজন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে থাকে। ভৌগলিক কারণে আগরতলা বাংলাদেশের কাছে হওয়ায় এখানে নেতা-কর্মী, শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা প্রথমে আসে। তারা প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আগরতলা এসেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রচারণা চালিয়েছে। আমাদের হোস্টেলে বহুসংখ্যক তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের আমরা আশ্রয় দিয়েছি। সেখানে খ্যাতমান ছাত্রনেতাসহ সাংস্কৃতিক দলের অনেকেই ছিলেন। এ দলটি সারা শহরজুড়ে মুক্তিযুদ্ধে গান-নাটক করে মাতিয়ে রেখেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিল।
যারা সম্মুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে এখানে এসেছিল তাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। হোস্টেলে আশ্রয় নেয়া কিছু শিক্ষার্থী একদিন আমাদের কাছে কিছু অস্ত্র-বিস্ফোরক চাইলো পাকিস্তানিদের সাময়িকভাবে প্রতিহত করতে। কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। তাদের গতি রোধ করতে পুল-ব্রিজ উড়িয়ে দিতে কিছু বিস্ফোরক দরকার ছিল। তখন ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উৎসমুখ ডুম্বুরে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছিল। পাহাড় ভেঙে রাস্তা তৈরির জন্য মাইন বিস্ফোরণ করা হতো। আমাদের মধ্য থেকেই একজন সেখান থেকে মাইন সংগ্রহ করতে। আমরা ডুম্বুরে গিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু বিস্ফোরক সংগ্রহ করে বাংলাদেশ থেকে আগত তরুণ বাঙালিদের দিয়েছিলাম।
ধীরে ধীরে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতে আসতে লাগলে। যারা কিছু টাকা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন তারা বাসা করে থাকতেন। আমাদের বাসা সীমান্ত থেকে অনেক দূরে হওয়া স্বত্ত্বেও একটি চট্টগ্রাম থেকে আসা একটি বাংলাদেশি পরিবার থাকতো। তাদের সাথে আমাদের আত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে।
ত্রিপুরা সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের থাকার জন্য অস্থায়ী ঘর বানানোর জন্য দায়িত্ব কোনো ঠিকাদারদের না দিয়ে তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দল ভাগ করে দেয়া হয়। আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অস্থায়ী শিবির নির্মাণের জন্য কাজ করি।