গ্রামীণ নারীদের ব্লাউজ পরাটা শেখ হাসিনার অবদান নয়
আরিফ জেবতিক, ফেসবুক থেকে : দেশের অর্থনীতিতে দুটো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে এরশাদের সময়ে। প্রথমটি হচ্ছে গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির প্রচলন। বাংলাদেশের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রির জনক বলে পরিচিত নুরুল কাদের চৌধুরী এ সময় এরশাদকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, তরুণ উদ্যোক্তাদের পক্ষে মিলিয়ন ডলার ব্যাংকে জমা রেখে গার্মেন্টের কাঁচামাল আনা সম্ভব নয়। তার পরিবর্তে ব্যাংকগুলো যদি বায়ারের কনফার্ম অর্ডারের এলসির বিপরীতে কাঁচামালের জন্য ব্যাংক ফাইনান্সে এলসি খুলে, তাহলে পুরোটা ব্যাংকের উপর রেখে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো শিপমেন্ট করতে পারবে এবং শিপমেন্টের পর বায়ারের পেমেন্ট দিয়ে ব্যাংকের ঋণ শোধ করবে।
এটি প্রচলিত ধারার কোনো সিদ্ধান্ত ছিলো না। এরকম একটি সিদ্ধান্ত এরশাদ নিতে পেরেছিলেন। যার কারণে বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। একই সময়ে পাকিস্তান ডেনিম উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম সেরা হলেও, তারা সিদ্ধান্তটি নিতে পারেনি। পাকিস্তানে গার্মেন্ট শিল্প তাই আর এগুতে পারেনি, বাংলাদেশে দ্রুত বিস্তার ঘটেছিলো। ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া নিয়ে কয়েকটা মেশিন নিয়ে যারা গার্মেন্ট শুরু করেছিলো, তারাই এখন দেশের বড় উদ্যোক্তা। আর গার্মেন্টের এই বিস্তারে, আমাদের গ্রাম থেকে নারীরা এসে শহরে ভিড় করেছেন। অতি অল্পদামে তারা শ্রম বিক্রি করেছেন বটে, কিন্তু অন্তত এতটুকুও এর আগে তাদের সুযোগ ছিলো না। নারী ক্ষমতায়নে এই নারীদের নীরব ভুমিকা আছে। অর্থনীতিতে বড় অবদান আছে।
এরশাদ আমলে আরেকটা বড় সিদ্ধান্ত ছিলো ক্ষুদ্রঋণের প্রচলন। ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের আইডিয়াটি এরশাদ লুফে নেন। তিনি প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুমোদন দেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেন। ক্ষুদ্রঋণ গ্রামেগঞ্জে পুঁজি বিস্তার করেছে এবং অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছে। এখনও একজন গরীব মানুষ এনজিও থেকে সহজে ঋণ নিয়ে ব্যাটারিচালিত টমটম চালিয়ে নিজের পরিবারের জন্য অন্ন সংস্থান করতে পারে গ্রামেগঞ্জে।
পরবর্তীতে ৯০ দশকে এই দুই খাতকেই সব সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে। বিএনপি করেছে, আওয়ামী লীগ করেছে। এমনকি বীভৎস হরতাল-অবরোধ-ভাংচুরের সময়ও গার্মেন্ট খাতকে এর বাইরে রেখেছে যখন যে বিরোধীদলে গেছে, তারা।
এরশাদকে আমরা স্বৈরাচার বলে গালি দেই, সময়কালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলাম। এখনও তার পল্টিবাজি রাজনীতি নিয়ে হাসি তামাশা করি। কিন্তু তার সময়ের যা অবদান সেটা না বলার কোনো কারণ নেই।
অঞ্জনা ব্লাউজের যে উদাহরণ টেনেছেন, এটি বাস্তব উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে সময়ে এই দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, পাট ছাড়া কোনো ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। সেই পাট গুদামগুলোও তথাকথিত বাম জঙ্গীরা নিয়মিত পুড়িয়ে দিত। আমরা অর্থনীতি নিয়ে স্ট্রাগল করেছি। কিন্তু এই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে ধীরেধীরে। এই সময়ে কৃষিতে বিপ্লব হয়েছে। নতুন নতুন জাতের ধান এসেছে, কৃষি সহায়তা ইউনিয়ন পর্যায়ে ছড়িয়েছে।
আমাদের মধ্যবিত্তরাই দুই ঈদ ছাড়া নতুন কাপড় কেনার সাহস করত না। এখন পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এসব একদিনের উপলক্ষেও মধ্যবিত্তরা কাপড় চোপড় কেনে। গ্রামে স্যান্ডেল পায়ে দেয়া মানুষ পাওয়া যায়। মেয়েরা স্কুলে যায়, গ্রামের নারীরা ব্লাউজ পেটিকোট পরে।
এটি একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম। এখানে একেকজন একেকভাবে অবদান রেখেছে। শেখ হাসিনার বড় অবদান হচ্ছে বিদ্যুৎ। জ্বালানি নিরাপত্তা ইকোনমির একটি বড় শর্ত, তিনি সেটি নিশ্চিত করেছেন।
কিন্তু গ্রামীণ নারীদের ব্লাউজ পরাটা শেখ হাসিনার অবদান নয়। সেই অর্থনীতির চাকা আশির দশকেই ঘুরতে শুরু করেছে।
অঞ্জনার মতো তেলবাজরা যখন ‘নেত্রী’ হয়ে ওঠেন, তারা সেটাকে অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু ইতিহাসের পাঠে সেটিকে অস্বীকার করার জো নেই। সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব