নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা ব্যাংকিং খাতের সাফল্যের যে বয়ান দিয়েছেন তা একদেশদর্শী ড. মইনুল ইসলাম
গত ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক সংবাদে দেখলাম, ১২ ডিসেম্বর বুধবার সকালে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ব্যানারে দেশের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকের ৩০ জনেরও বেশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক এক সংবাদ সম্মেলন করে গত দশ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিতকরণে ব্যাংকিং খাতের প্রশংসনীয় সাফল্যের বয়ান তুলে ধরেছেন। পাঠকদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, এবিবি হচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন। পরদিন বেসরকারী ব্যাংকের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) গবেষণা সংস্থা সিপিডি কর্তৃক ব্যাংকিং খাত থেকে বাইশ হাজার পাঁচ’শ কোটি টাকারও বেশি লোপাট হওয়ার দাবিটিকে অবাস্তব অভিহিত করে ঐ ভিত্তিহীন দাবি করার জন্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন এবিবি’কে মাঠে নামানোর বিষয়টি ওয়াকিবহাল মহলের কাছে ব্যাংক-মালিক এবং ক্ষমতাসীন সরকারের প্রত্যক্ষ চাপের মাধ্যমে ঘটানো একটি অনভিপ্রেত উদ্যোগ হিসেবেই চিন্তিত হয়েছে ইতোমধ্যে। বেসরকারী ব্যাংকের মালিকরা এখন সরকারের নানাবিধ অন্যায্য পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তাঁদের ব্যাংকগুলোর ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ অনেকখানি বাড়িয়ে ফেলেছেন, এটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নয়। অতএব, তাঁদের পক্ষ থেকে হুকুম দেওয়া হলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা ক্ষমতাসীন সরকারের উন্নয়ন দশকের বয়ান দিতে ‘মিট দি প্রেস’ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে বাধ্য হবেন বোঝাই যায়। কিন্তু, জমজমাট নির্বাচনী প্রচারের সময়টায় এধরনের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যগুলোকে সাধারণ জনগণ তেমন একটা গুরুত্ব না দিলে আয়োজকদের উদ্দেশ্যটা অনেকখানি ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। আমি অবশ্য ব্যাপারটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাই। ব্যাংকিং খাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা যখন একমত হয়ে ঘোষণা করেন যে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা যতখানি খারাপ বলে সিপিডির গবেষণায় উঠে এসেছে আসল অবস্থা অতোখানি খারাপ নয় তখন আমানতকারীরা তাঁদের আমানতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগাকুল হবেন না। আসলে গ্লাসের অর্ধেক পানিতে ভরা আরঅর্ধেক খালিথাকলে একপক্ষ খালি থাকার বিষয়টিকে হাইলাইট করতে পারেন, আরেকপক্ষ ভরা গ্লাসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারেন। আমি ব্যাপারটায় বেশ কিছুটা আমোদ খুঁজে পাচ্ছি। ব্যাংকিং খাতের সাফল্যকে হেলাফেলা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়, আবার ব্যাংকগুলো যে দেশের পুঁজি-লুটেরাদের জন্যে ‘কামধেনুর’ ভূমিকা পালন করছে সেটা অস্বীকার করাও জ্ঞানপাপীর কাজ হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পালে জোর হাওয়া লেগেছে, সেটা সারা বিশ^ই উপলব্ধি করছে। আর, এই উন্নয়নে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে সেটাও অস্বীকার করার কোন কারণ নেই। এদেশের পুঁজিবাজার (প্রধানত শেয়ারবাজার) অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে উদ্যোক্তাদেরকে এবং উৎপাদনশীল জনগণকে পুঁজি যোগানোর দায়িত্ব পালনে এখনো অনেকখানি অপারগ রয়ে গেছে। সেজন্যে, এই কঠিন দায়িত্বটি পালন করতে হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থবাজারের মূল প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলোকে। সাধারণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, অর্থবাজারের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল দায়িত্ব হলো বিনিয়োগকারীদেরকে এবং ঋণগ্রহীতাদেরকে স্বল্পমেয়াদী ঋণের যোগান দেওয়া, আর পুঁজিবাজারের প্রতিষ্টানগুলো কাঠামোগতভাবে উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার কথা দেশের বিনিয়োগকারীদেরকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণপত্র বেচাকেনার মাধ্যমে পুঁজির যোগান দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর অর্থনৈতিক ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে জার্মানী এবং জাপানের ক্ষেত্রে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাজারের চাইতে ব্যাংকিং খাত অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল। অন্যদিকে, ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং-এর চাইতে শেয়ারবাজার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দক্ষিন কোরিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাংকিং অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে, গণচীনের ক্ষেত্রেও ব্যাংকিং-এর ভূমিকাই মুখ্য। কিন্তু, স্বল্পমেয়াদের ঋণ সরবরাহের জন্যে যেহেতু ব্যাংকগুলোর কাঠামো ও রীতিনীতি গড়ে তোলা হয় তাই ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সরবরাহ করতে বাধ্য করা হলে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া খুবই কঠিন হয়। উপরন্তু, ঋণ প্রদানের ব্যাপারে সরকার বা ব্যাংকের মালিকপক্ষ হস্তক্ষেপ করলে ঋণের মান খারাপ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আর, ব্যাংকের পুঁজি সরবরাহ যদি দেশের ধনাঢ্য গোষ্ঠিগুলোর খেদমতে নিয়োজিত হয়ে যায় তাহলে ব্যাংকিং খাত দেশে শত শত ধনকুবের পরিবার সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে জোরদার করায় ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানে বাইশ পরিবার সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাংক-পুঁজি লুন্ঠনের মাধ্যমে, আবার বাংলাদেশেও এখন যে ২৫৫ জন ধনকুবের সৃষ্টি হওয়ার খবর দিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ তাদের প্রায় সবাই ধনকুবের হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে চলেছে ব্যাংকিং খাত। অতএব, স্বীকার করতেই হবে যে দেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণের ওপর একটি ক্ষুদ্র ধনাঢ্য গোষ্ঠির নিয়ন্ত্রণ যতই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে পরিণত হবে ততই দেশের আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাবেই।
আমরা অনেকেই হয়তো ভুলে গেছি যে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের২১ দফা ইশতেহার থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রণীত এগার দফায় এবং ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দেশের ব্যাংকিং খাতকে জাতীয়করণের অঙ্গীকার জনগণের প্রাণপ্রিয় দাবি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই দাবি বাস্তবায়নের জন্যেই ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।আমাদের দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে দেশে ব্যাংকিং খাত দ্রুত প্রসারিত হলেও অর্থনীতিতে বিনিয়োগের গতি তরান্বিত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিল ঐ সময়ের অর্থনৈতিক দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ঐ সময়ে প্রচন্ড আমানতের স্বল্পতা সমস্যায় জর্জরিত ছিল, একইসাথে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের লোকসানী কল-কারখানা ও সেক্টর করপোরেশনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ঋণ যোগান দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলো সাধারণ জনগণের ঋণের চাহিদা তেমন মেটাতে পারেনি। ঐ সময় বাংলাদেশের ‘সঞ্চয়-জিডিপি অনুপাত’ ছিল মাত্র চার শতাংশ, এখন স্বাধীনতার ৪৭ বছরে দেশের ‘সঞ্চয়-জিডিপি’ অনুপাত’ বেড়ে প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। বিশেষত, দেশের এক কোটি কুড়ি লাখেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্সের কল্যাণে দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানত প্রবাহের ঢলও দিনদিন বেগবান হয়ে চলেছে। এরই ফলশ্রুতিতে দেশের বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধির হার ক্রমবর্ধমান। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দেশের ব্যাংকিং খাত এই ক্রমবর্ধমান আমানতের জোয়ারকে বিনিয়োগের জোয়ারে রূপান্তরিত করতে পারছে না ব্যাংক-ঋণ লুটেরাদের পুঁজি-লুন্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের কারণে। আমরা এখন ভুলে গেছি যে সত্তর দশকের শেষার্ধে দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে লুটপাটের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছিল সমরপ্রভু জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। প্রেসিডেন্ট জিয়া তাঁর জাগদল ও বিএনপি গঠনের প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদেরকে কেনার লোভনীয় টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বাংক-ঋণকে। আজকের দিনের ঋণখেলাপি সমস্যার সূত্রপাতই হয়েছিল ঐ সময় থেকে। সমরপ্রভু এরশাদের সময় ব্যাংকঋণ-লুন্ঠন ‘কালচারে’ পরিণত হয়েছে। গত ২৮ বছরের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর সময়ে ব্যাংকঋণ-লুন্ঠন ক্রমশ দুরারোগ্য ক্যান্সারের রূপ ধারণ করেছে। এই সমস্যাটিকে অস্বীকার করে কিংবা সংকটকে নানা কায়দায় কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলে এই সংকট থেকে পরিত্রাণ মিলবে না। ২০১০ সালে প্রকাশিত আমার ও মহিউদ্দিন সিদ্দিকীর গবেষণা গ্রন্থ এ প্রফাইল অব ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দি প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ-এ প্রমাণিত হয়েছে ৭৭ শতাংশ রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি তাঁদের রাজনৈতিক কানেকশান ব্যবহার করে লোভনীয় ঋণগুলো বাগিয়েছেন এবং তাঁদের সিংহভাগই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’। মানে, তাঁরা তাঁদের ব্যাংক-ঋণ কখনোই পরিশোধ করতে হবে না ধরে নিয়েই ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’ হয়ে গেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ-লুন্ঠন সুসম্পন্ন করে এখনএসব রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা হাত বাড়িয়েছেন প্রাইভেট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে যেসব রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান তাঁরা ঋণগুলো রিশিডিউলিং করে নিয়মিত করার পন্থা অনুসরণ করে নির্বাচন কমিশনের শর্তপূরণে সক্ষম হন অথবা উচ্চতর আদালতে অর্থঋণ আদালতের রায় স্থগিত থাকায় নির্বাচনে তাঁরা অযোগ্য হন না, এটা এবারও প্রমাণিত হয়েছে। ফলে, নির্বাচনে প্রার্থীতার শর্ত দিয়ে ঋণখেলাপি সমস্যার কোন উন্নতি হবে বলে দুরাশা করা উচিত হবে না। আমি বারবার বলে চলেছি, রিশিডিউলিং এর ক্যান্সারের বিস্তারে ব্যাংকারদের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করা জ্ঞানপাপীর কাজ হবে। ব্যাংকের ব্যবস্থ’াপনা পরিচালকদের চাকুরি যখন দিনদিন ব্যাংকের মালিকদের খামখেয়ালির শিকার হয়ে যাচ্ছে তখন তাঁরা ঋণের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিতে আরো অপারগ হয়ে যাচ্ছেন, সেটাও বোঝা প্রয়োজন।
আমি দৃঢ়ভাবে বলে চলেছি, খেলাপি ঋণ সমস্যা তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে যতখানি প্রকাশিত হচ্ছে তার চাইতে অনেক বেশি গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে।কিছুদিন পরপর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ক্লাসিফাইড লোনের যে হিসাব প্রকাশ করা হয় সেটাকে আমি বরাবরই প্রতারণামূলক আখ্যায়িত করে আসছি, কারণ ঐ প্রকাশিত হিসাবে খেলাপি ঋণের যে অংশটা অবলোপন (রাইট-অফ) করা হয়েছে তার সুদাসলে স্থিতি কত হয়েছে সে পরিমাণটা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ফলে অবলোপনকৃত ঋণের সুদাসলে পরিমাণ ক্লাসিফাইড লোনের সাথে যোগ করে মোট খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ কত তা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। ২০০২ সালে রাইট-অফ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ২০০৪ সাল পর্যন্ত অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা নিয়মিতভাবে প্রতি তিনমাস পরপর প্রকাশ করা হতো, কিন্তু যখন ঐ হিসাব পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছিল যে কোন ব্যাংকই অবলোপনকৃত মন্দঋণ তেমন একটা আদায় করতে পারছে না তখন হঠাৎ করে ঐ হিসাবটা আর প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এরপর থেকে আমি বেশ কয়েকবার রাইট-অফ্ করা ঋণের হালনাগাদ হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশের দাবি জানিয়েছি, কোন ফল পাইনি। আমি দাবি করে আসছি, যে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি মন্দঋণ ২০০২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অবলোপন করা হয়েছে সুদাসলে তার ব্যালেন্স এই ১৬ বছরে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবার কথা। এর সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক যে এক লাখ কোটি টাকা ক্লাসিফাইড লোন হিসেবে দেখাচ্ছে সেটা যোগ করলে সত্যিকার খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর, অবৈধভাবে যে মন্দঋণ বারবার রিশিডিউলিং করা হচ্ছে সে মন্দঋণের পরিমাণ যোগ করলে প্রকৃত মন্দঋণের ভয়াবহ সংকটটি জনগণ জানতে পারতেন। আমানতের ঘাটতি সমস্যা না থাকায় ব্যাংকগুলো এই সংকটটাকে লুকোবার পন্থাগুলো সফলভাবে ব্যবহার করতে সমর্থ হচ্ছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা প্রকৃত সংকট কতখানি গুরুতর সেটা ঠিকই জানেন, কিন্তু জনসমক্ষে তাঁরা অপ্রিয় সত্যকথাগুলো কখনোই বলতে পারবেন না। আর, সরকার কিংবা ব্যাংকের মালিকরা আদেশ করলে প্রেস কনফারেন্স করে ‘উন্নয়ন-দশকের’ সাফল্যের ফিরিস্তিও তাঁদেরকে দিতে হবে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও সাফল্যের আরেকটি ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়েছিল। একটি রাজনৈতিক জোটের সরকার নির্বাচনের স্বার্থে এই ধরনের কৌশল অবলম্বন করলে অবাক হবার কিছু নেই। বিশেষত, সিপিডি’র প্রেস কনফারেন্সের টাইমিংও কোন মহলের কাছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিবেচিত হলে সেটার জবাব দেওয়ার তাগিদ বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক নয় কি?
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়