কর্মজীবী নারী এবং শিশু প্রতিপালন
মৃত্তিকা পাল স্বর্ণা
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা বিখ্যাত লাইন হল, বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। লাইনটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর লাইন হলেও একজন কর্মজীবী মায়ের পক্ষে শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ সর্বক্ষণ প্রায় অসম্ভব। অপরদিকে দেখা যাচ্ছে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। শুধু সন্তান প্রতিপালনের অসুবিধার কারণে অনেক মা তার কর্মক্ষেত্র ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। শিশুকে একা ঘরে রেখে যাওয়া একটি অসম্ভব বিষয়। এদিকে গৃহকর্মীর কাছে যে সন্তান রেখে যাবে সেখানেও নানা রকম দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। তারপর শিশুটি একটু বড় হলে তাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসা সবটুকু দ্বায়িত্ব যেন একজন মায়ের ওপরই চলে আসে। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ছয় মাস। কিন্তু এই সময়টা নিতান্তই কম। যেসব প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৪০ জন নারীকর্মী রয়েছেন সেখানে একটি শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র থাকার বিধানও রয়েছে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে হয়তো নারীকর্মীর সংখ্যা ৪০ জনের কম, সেখানকার নারীরা কোথায় তাদের ছোট শিশুকে রেখে যাবেন তা ভেবে পান না। একজন কর্মজীবী নারীকে অফিস করে শুধু তার সন্তান না পুরো সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়। কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরে এসে একজন কর্মজীবী নারীকে গৃহিণীর মত করেই চিন্তা করতে হয় তার পরিবার রাতে কি খাবে আগামীকাল সকাল এবং দুপুরে কি হবে এবং রাতে ফিরে এসে তার কাজটা কি হবে? কর্মজীবী নারীরা চাকরি করছেন, সন্তান পালন করছেন এবং সংসার করছেন তারা, একসাথে তিনটি কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি চাকরি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পেশা ও উৎপাদনশীল খাতে নারীর অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে কর্মজীবী নারীর সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত দিবাযতœ কেন্দ্র থাকা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকাতে বেশ কয়েকটি দিবাযতœ কেন্দ্র থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পর্যাপ্ত দিবাযতœ কেন্দ্র অভাব ও কর্মস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার না থাকায় কর্মজীবী মায়েরা সন্তানের যথাযথ যতœ নিতে পারছেন না। তারা সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তায় কাজেও মনোযোগ দিতে পারেন না। কর্মজীবী নারীদের জন্য সব প্রতিষ্ঠানেই দিবাযতœ কেন্দ্র থাকা জরুরি। সন্তান প্রতিপালনে মায়ের সাথে সাথে বাবার ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষণীয় যে, সন্তান পালনে বাবার ভূমিকা অর্থ উপার্জন, আর কখনো কখনো পড়া বুঝিয়ে দেয়ার মধ্যেই সীমিত। সন্তানের অসুস্থতায় বাবা অবশ্যই বিচলিত হন। কিন্তু কোনো বাবাকেই দেখা যায় না, সন্তানের জ্বর হয়েছে বলে দিনের পর দিন অফিস ছুটি নিতে সেখানে সন্তানকে নিজের কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়া তো বেশ অকল্পনীয় বিষয়। কিন্ত যদি একজন পুরুষ ঘরের কাজে নারীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তবে সেই কর্মজীবী নারীর সন্তান লালন-পালনে যে তীব্রতর কষ্ট তা কমে যাবে অনেকখানি। ঘরের কাজ মিলেমিশে করলে জীবনযাপন অনেকটা সহজ হবে বদলে যাবে পারিবারিক দৃশ্যপট। বড় শহরগুলোতে একক পরিবারের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। শিশুর জন্য দিবাযতœ কেন্দ্র সহজলভ্য হওয়া এখন সময়ের দাবি। সারাদেশে সব শ্রেণির মানুষের জন্য যত বেশি সংখ্যক শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে কর্মক্ষেত্রে মায়েরা ততো বেশি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবেন আর শিশুরাও থাকবে নিরাপদে।
লেখক পরিচিতি : লেকচারার, ডিপার্টমেন্টে অফ বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি