ক্ষুদ্র স্বার্থের বৈদেশিক সাহায্য
আবু তাহের খান
অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য বাংলাদেশ বর্তমান যে পরিমাণ ও যে ধরনের বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করছে, তার কতোটা যৌক্তিক ও কতোটা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই দেশে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা অব্যাহত আছে। তবে সে সব আলোচনায় রাষ্ট্র ও সমাজের প্রভাবশালী মহলের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। কারণটি বোধগম্য। সম্প্রতি পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ কানাডার আদালতে খারিজ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে তাই এখানে আবারো খানিকটা আলোকপাত করার চেষ্টা করা হলো।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের ১,১০,৭০০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ হচ্ছে ৪০,০০০ কোটি টাকা (মোট বরাদ্দের প্রায় ৩৬ শতাংশ), যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। বস্তুতঃ বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশমান চলতি ধারার প্রেক্ষিতে এই হ্রাস পাওয়াটাই স্বাভাবিক এবং একইসঙ্গে তা কাম্যও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, দেশের অধিকাংশ বিরোধী দল ও সংবাদ মাধ্যম বৈদেশিক সাহায্য হ্রাস পাওয়াকে সরকারের ব্যর্থতা বা বাংলাদেশের ওপর বিদেশিদের আস্থা হ্রাস পাওয়ার লক্ষণ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করে থাকে।আর, সংবাদ মাধ্যমও রাজনীতির এ ধরনের জনপ্রিয় আলোচনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এ থেকে ফায়দা লুটে বাংলাদেশের এবং দাতা দেশ ও সংস্থাসমূহের কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। বিষয়টি শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়—অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনার বিষয়ে এটি তাদের অজ্ঞতাকেও তুলে ধরে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে উদ্দেশ্যমূলকভাবেও করা হয়ে থাকে। তা, সেটি অজ্ঞতা বা উদ্দেশ্যমূলকতা—যাই হোক না কেন, ক্রমাগত প্রচারের ফলে সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, বৈদেশিক সাহায্য হ্রাস পাওয়া মানে উন্নয়নের গতি থেমে যাওয়া বা বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশিদের আস্থা হ্রাস পাওয়া।
এবার বাস্তব পরিস্থিতিকে একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। এক সময় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ঘাটতি মোকাবেলার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জনসম্পদ ও সামাজিক কাঠামো উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ এবং অন্যান্য সাহায্যের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান প্রভৃতি দেশের ওপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায়, উৎপাদন ও সেবাখাতের ব্যাপক বিকাশ ঘটায়, সঞ্চয় বৃদ্ধির সুবাদে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ দেশ বা দাতা সংস্থার সহায়তা এখন আর তেমনটি অত্যাবশ্যকীয় নয়। বরং বাছ-বিচারহীন বৈদেশিক সাহায্য রাষ্ট্রের বৈদেশিক ঋণের বোঝাকেই শুধু অহেতুক বাড়িয়ে তুলছে, যা মেটাতে গিয়ে বিনিয়োগের পরিমাণ যে হারে বাড়তে পারতো, তারচেয়ে অনেক কম হারে তা বাড়ছে। এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কর্তৃক বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণের পরিমাণ যতোটা কমানো যাবে, দেশ ও জনগণের জন্য তা ততোটাই মঙ্গলজনক হয়ে ওঠবেবলে আশা করা যায়।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে, বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণের পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সব ধরনের বস্তুগত পরিস্থিতি বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক অর্থ সহায়তা বাংলাদেশ গ্রহণ করেই চলেছে। কিন্তু কেন? বিষয়টি নিয়ে প্রায় কেউই খোলামেলা আলোচনা করতে চান না। কারণ বিষয়টি যারা গভীরভাবে বোঝেন, তাদের একটি বড় অংশেরই স্বার্থের নাটাইওই বৈদেশিক সাহায্যের সাথে কোনো না কোনোভাবে লেপ্টে আছে। ফলে বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে কানাডীয় আদালতের রায় ঘোষণার পর যেমন অনেক ‘সুশীলই’ চুপ করে আছেন, বৈদেশিক সাহায্যের বিষয়েও তেমনি অনেক ‘বিশেষজ্ঞ’ চুপ করে থাকেন।
প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বহুক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেমন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করছে, তেমনি অপ্রয়োজনে বহু দাতাও তাদের নিজস্ব স্বার্থে উপযাচক হয়ে বাংলাদেশকে অনেকটা জোর করেই সাহায্য দিতে চায় বা দিচ্ছেও। উদাহরণ দিয়ে বিষয়গুলোকে খোলাসা করা যাক। প্রথমেই আসা যাক প্রযোজনীয় বৈদেশিক সাহায্য কেন গ্রহণ করা হয় সে প্রসঙ্গে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এসব বৈদেশিক সাহায্যের একটি বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে যানবাহন ক্রয়, বিদেশ ভ্রমণ, সেমিনার-কর্মশালাআয়োজন, পরামর্শক নিয়োগ ইত্যাদি খাতে। আর এগুলোর উপকারভোগীদের মধ্যে আমলাতন্ত্রের কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরা যেমনি আছেন, তেমনি আছেন বিদেশিদের কাছে অতি আদরণীয় এনজিও ধারণার সমর্থক পরামর্শকরাও। আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী প্রভৃতি গোষ্ঠীর বিশেষজ্ঞরাও। ফলে যাদের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প গ্রহণে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে তারাই যে মূল নীতি-নির্ধারক ও সিদ্ধান্ত প্রণেতা, তাতে আর সন্দেহ কী! ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প এ দেশে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হয়েই চলেছে, যার সাথে জনস্বার্থের বলতে গেলে তেমন কোনো সম্পর্কই নেই।
অন্যদিকে, দাতারা কেন উপযাচক হয়ে জোর করে সাহায্য দিতে চায় তার একটি ছোট্ট উদাহরণ পাওয়া যাবে কানাডার আদালতের রায়ের বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত ১১ ফেব্রুয়ারি (২০১৭) সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া শিল্পসচিব জনাব মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়ার একটি বক্তব্য থেকে। তিনি বলেছেন, পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক থাকতে না পারায় তাদের কারো কারো চাকরি গেছে (প্রকল্প থাকলে তারা চাকরি করে খেতে পারতো। আর এ জাতীয় চাকরি রক্ষা করতে না পারায়ও কারো কারো চাকরি গেছে)। তবে এটি শুধু বিশ্বব্যাংক নয়—অন্যান্য কোনো কোনো দাতা দেশ ও সংস্থার ক্ষেত্রেওপ্রযোজ্য, এমনকি জাতিসংঘের অনেক অঙ্গসংস্থাও এর বাইরে নয়। বস্তুতই এসব সহায়তাদান প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের চাকরি বাঁচাবার জন্য এবং কখনো কখনো সেখানে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টির জন্য এ ধরনের বহু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশে সুনাম রয়েছে—এমন সাহায্য সংস্থাও তাদেরপূর্বের সাহায্যের সূত্র ধরে নিছক তার কর্মীদের চাকরি বাঁচাবার জন্য এখনো এমন অনেক সাহায্যদানের সঙ্গে জড়িত, যে ধরনের সাহায্য কোনোভাবেই ‘প্রকল্প সাহায্যে’র প্রকৃতির মধ্যে পড়ে না। ওইসব সাহায্যে যে জাতীয় কাজ হচ্ছে, তার জন্য ওই ধরনের সাহায্য নেয়ার কোনোই যুক্তি নেই। এগুলোর জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নই যথেষ্ট। এমনকি চেষ্টা করলে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সরকারের নিজস্ব উদ্যোগেও এ ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
এনজিওদের নাম শুনলেই আমাদের দাতারা উল্লসিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করে বলুন তো, গত ৪৫ বছরে দেশের উন্নয়নের নামে এনজিওরা বিদেশিদের কাছ থেকে মোট কত অর্থ গ্রহণ করেছে এবং তার বিপরীতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা কতটুকু অবদান রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ পল্লী উন্নয়নের কথাই ধরা যাক। এনজিও পরিচালিত তথাকথিত ক্ষুদ্রঋণ এ দেশের পল্লী উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে, আর নানা অদক্ষতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এ ক্ষেত্রে কতটুকু অবদান রেখেছে!
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা এডিবির মতো দাতারা বাংলাদেশকে বহু ক্ষেত্রে ভুল পরামর্শও দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ক্রমাগত ভুল পরামর্শে বিদ্যুৎখাতে প্রকৃত দক্ষতা না বাড়িয়ে একের পর এক শুধু প্রতিষ্ঠান ভাঙার পরামর্শ (কনসালটেন্সি) দেয়া হয়েছে, তাতে দাতাদের কনসালটেন্টরা নাদুস-নুদুস থাকলেও ১৯৯৬ সনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাত ক্রমাগত কেবল দুর্বলই হয়েছে। রেলওয়ের ক্ষেত্রে এডিবিরও বহু ভুল পরামর্শ রয়েছে।
সরকারের বাস্তবায়ন পরীবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ৩ মাস পরপর এডিপি বরাদ্দের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনাকল্পে যে প্রতিবেদন তৈরি করে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেখানে প্রকল্প সাহায্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে মন্থর অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে, যার জন্য বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কারো কারো অদক্ষতা ও অযোগ্যতার বিষয়টি অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু এরচেয়েও বেশি রয়েছে কৃত্রিম উপায়ে অপ্রয়োজনীয় খাতে প্রকল্প সাহায্য বরাদ্দ দিয়ে স্থানীয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষের স্বার্থ এবং দাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের অনেকের চাকরি রক্ষার বিষয়টি। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম বা অন্যবিধ আলোচনায় সেটি প্রায় আসে না বললেই চলে। আর প্রায় কখনোই আসে না আইএমইডি বা সরকারের নিজস্ব আলোচনায় যে, অপ্রয়োজনীয় খাতে বৈদেশিক সাহায্য বরাদ্দ করাটাও অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মন্থর অগ্রগতির একটি অন্যতম কারণ।
অতএব এখন সময় এসেছে, জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন এসব বৈদেশিক সাহায্যের অভিশাপ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে আনা। আর সে ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু নিয়ে কানাডীয় আদালতের রায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি চমৎকার সুযোগ ও উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেবলে মনে করি, যার সদ্ব্যবহার বাংলাদেশের অবশ্যই করা উচিত। মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সাহায্য দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলেই মালয়েশিয়াকে তিনি অতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। মালয়েশিয়ার সবকিছুই আমাদের জন্য অনুকরণীয় নয়। আমাদের উন্নয়ন কৌশল আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন ও বাস্তবতা অনুযায়ীই হতে হবে। তবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ অপ্রয়োজনীয় দাতাদের প্রত্যাখানের ব্যাপারে মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলেই বিশ্বাস করি।
লেখক : পরিচালক, ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ধঃশযধহ৫৬@মসধরষ.পড়স