মধ্যবিত্তের সামর্থ্য বৃদ্ধি বনাম তার ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ
আবু তাহের খান : বাজার অর্থনীতির এ যুগে বহুজাতিক উৎপাদকেরা সর্বদাই পাখির চোখের মতো শ্যেনদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন কোথায় কোন নতুন ভোক্তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, সে আশায়। পুরনো ভোক্তার চালচলন ও গতিবিধির প্রতিও থাকে তাদের নিরন্তর নজরদারি, যাতে কোনোভাবেই চাহিদার ফাঁক গলিয়ে সে অন্যের প্রলোভনে পা দিতে না পারে। আর এ দ্বিবিধ লক্ষ্যকে সামনে রেখে মাঝে মাঝেই তারা বিশ্বের এখানে-ওখানে বাজার জরিপে নামেন ভোক্তার সর্বশেষ অবস্থা ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য। এমনি এক বাজার জরিপের বিষয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে যে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থিক সামর্থ্য ক্রমেই বাড়ছে। তবে ঐ তথ্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা ভোক্তা শ্রেণির যে বৈশিষ্ট্যের কথা জরিপকারীরা খোলাসা করে বলেননি তা হচ্ছে, তাদের সামর্থ্য বৃদ্ধির চেয়েও দ্রুত হারে বাড়ছে তাদের ভোগের প্রবণতা। বিষয়টি বহুজাতিকদের জন্য উসৎসাহব্যজ্ঞক হলেও বাংলাদেশ-সমাজের জন্য তা মোটেও কোনো সুখবর নয়। বরং তা অনেকটাই উদ্বেগজনক এ কারণে যে, বিকাশমান এ অর্থনীতির উচ্চতর প্রবৃদ্ধির লাভের গুড়ের সিংহভাগ যদি পিঁপড়ায়ই খেয়ে ফেলে, তাহলে সে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ধারা টেকসই হওয়ার ব্যাপারে ঝুঁকিই শুধু বাড়ে না—সমাজে ক্ষতিকর অন্য নানা উপসর্গও দেখা দেয়, যার মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় অন্যতম।
উপরের শেষোক্ত ওই উপসর্গ অর্থাৎ মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে যেয়ে প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মধ্যবিত্তের ভোগপণ্য ক্রয়ের সামর্থ্য ও প্রবণতা যতোই বাড়ছে, ততোই অবক্ষয়ের দিক যাচ্ছে তার অতি উচ্চ মানের চিরায়ত মূল্যবোধগুলোও। আর অর্জন ও অবক্ষয়ের এ দ্বন্ধে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার প্রচলিত মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে শুধু উচ্চতর প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে, নাকি রাষ্ট্রের নৈতিক সমর্থন আদায় এবং সচেতন জনগণের দৃঢ় ও প্রত্যয়ী অবস্থান ধরে রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ঐতিহ্যের সমৃদ্ধতর অংশকে টিকিয়ে রাখতেও সমর্থ হবে, সেটির উপরই মূলত নির্ভর করছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভবিষ্যৎ চরিত্র ও রূপকাঠামো। আশা করা অন্যায় হবে না যে, এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের সমন্বিত রূপই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে। কিন্তু কিভাবে ?
এই সেদিনও বাঙালি মধ্যবিত্তের নানামাত্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার প্রতি অনুরাগ, কল্যাণ, সহমর্মীতা ও মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকারদান, অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন, যৌথ পরিবারে বসবাসে আগ্রহ এবং সর্বোপরি একটি উন্নততর জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকাঙ্খা। কিন্তু জনগণের মাথাপিছু আয় (১৯৭২ ছিল ১২৯ মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩১৪ মার্কিন ডলারে) যতোই বাড়ছে, মধ্যবিত্তের এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রে ততোই ঘটছে অতি দ্রুত হারে গুণগত অবনমন।
শিক্ষার প্রতি আকাঙ্খার কথাই ধরা যাক। ইংরেজরা বণিকবৃত্তি নিয়ে এ দেশে এসে শেষ পর্যন্ত রাজদ- হাতে নিলেও শিক্ষাকে তারা কখনোই পণ্য করে তোলার চেষ্টা করেনি (ঔপনিবেশিক শাসনের গুণকীর্তন করা হচ্ছে না)। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও শিক্ষার যাত্রা সর্বজনীন অধিকারের অংশরূপেই শুরু হয়েছিল। আর এ ধারাবাহিকতায় শিক্ষা গ্রহণ করে সে যোগ্যতা ব্যবহারের মাধ্যমে আয়ের পথ উন্মোচিত হলেও বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসিকতাতে শিক্ষা ছিল মূলত জ্ঞান আহরণের মাধ্যম।
কিন্তু ১৯৮০-র দশকের শেষ প্রান্ত থেকেই ক্রমান্বয়ে শুরু হয় ভিন্নপথে যাত্রা। সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই বিজ্ঞান বা অন্য মৌলিক বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে আগ্রহী হয়ে ওঠে অধিক উপার্জন-সহায়ক শিক্ষার প্রতি। ফলে জীবনের জন্য শিক্ষার প্রকৃত আবেদনটিই-যে শুধু ক্ষুন্ন হতে থাকে তাই নয়, নয়া জ্ঞান সৃষ্টি এবং আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের সৃজনশীল ধারায় যুক্ত হবার সুযোগ ও সম্ভাবনা থেকেও নতুন প্রজন্ম বঞ্চিত হতে থাকে। এ অধঃগামিতা বাঙালিকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে ঠেকাবে বা নিজেদেরকে শুধুই ভোক্তার জাতিতে পরিণত করবে কিনা, সে আশঙ্কা থেকেই যায়।
শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রতি বাঙালি মধ্যবিত্তের যে অসীম আগ্রহ, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখাতেও তার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। আর রবীন্দ্রনাথের কালে সেটি ঠাকুরবাড়ির আঙিনা পেরিয়ে অন্য সাধারণ মধ্যবিত্তের ওঠোন পর্যন্ত পৌঁছাবার বিষয়টি বলতে গেলে প্রায় সর্বজনবিধিত ঘটনা, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ ধারা ক্রমশঃই আরো বেগবান হয়ে ওঠবার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং বলতে কি, নতুন দেশে এটিই হয়ে দাঁড়ায় উঠতি মধ্যবিত্তের অহঙ্কারের মূল জায়গা। শহর-মফস্বলেতো বটেই, এমনকি সাধারণ গ্রামগঞ্জেও শিক্ষিত তরুণ-যুবারা গান, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদির মধ্যে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে প্রয়াসী হয়। এটি তাদের জন্য আর্থিক উপার্জনের পথ সুগম না করলেও এসবের মধ্য দিয়ে তারা সমাজের ভেতর এক ধরনের প্রগতি মনষ্কতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকেই শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার এ ধারায় বড় ধরনের বাঁক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মঞ্চে নাটক দেখা, মিলনায়তনে বা খোলা মাঠে গান শোনা, নানা উপলক্ষকে সামনে রেখে ছোটকাগজ প্রকাশ ইত্যাদির চর্চা থেকে সরে যেয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত ক্রমেই বিনোদনের আশ্রয় খুঁজতে থাকে টেলিভিশন বা কম্পিউটারের মধ্যে।
আত্মস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে সামাজিক কল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার মানসিকতা, অন্যের বিপদ, কষ্ট ও সমস্যায় এগিয়ে যেয়ে তার পাশে দাঁড়ানোর সহমর্মীতা ইত্যাদির মতো মানবিক মূল্যবোধগুলো এ দেশের জনজীবন থেকে ক্রমেই তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের কল্যাণ সমিতি বা শহরের পাড়াভিত্তিক তরুণ সংঘ—এগুলো এখন প্রায় ওঠেই যাচ্ছে। রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা বা ঝগড়াবিবাদ ঘটলে, কেউ কাউকে অহেতুক অপদস্ত করলে কিংবা প্রকাশ্যে কোথাও অন্যায় দেখলে এক সময় মধ্যবিত্ত নাগরিক সেখানে এগিয়ে যেয়ে প্রতিকারের চেষ্টা করতো। আর এখন এগিয়ে যেয়ে সাহায্য বা প্রতিকার করার বদলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে কেটে পড়াটাকেই মানুষ সর্বোত্তম উপায় বলে মনে করে। এবং অধিকতর উদ্বেগের বিষয় এই যে, মধ্যবিত্তের এ পলায়নপর মনোবৃত্তি এবং প্রতিবাদবিমুখ মানসিকতা ক্রমশই আরো প্রবল হয়ে ওঠছে।
খুব স্বাভাবিক কারণেই দেশে নগরবাসী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশের প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ এখন শহরে বসবাস করে। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, নগরায়ন বা নগরবাসী মানুষের সংখ্যা যতোই বাড়ছে, ততোই ভেঙে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক প্রথার বন্ধন ও কাঠামোটি। ক্রমেই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে পড়া নতুন আঙ্গিকের এ পরিবার প্রথা যতোই ব্যক্তির স্বাতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণার অনুগামী হোকনা কেন, এসব পরিবারের সন্তানেরা বস্তুত এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। সমাজে মাদক, পর্নোগ্রাফি, কিশোর অপরাধ, জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের প্রতি আসক্তি ও এ ধরনের অনাকাঙ্খিত প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে উল্লিখিত বিচ্ছিন্নতার গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলেই সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা।
আর রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে, সেখানে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা কিভাবে নিশ্চিত হবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ কিভাবে বাড়ানো যাবে ইত্যাদি বিষয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্রমশ এক ধরনের নির্লিপ্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আপাতদৃষ্টে এটিকে দোষণীয় বলে মনে না হলেও এর দীর্ঘমেয়াদী কুফল খুবই মারাতœক হতে পারে। কারণ, এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনয় মেধাবী মানুষদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেওয়ার সমূহ আশঙ্খা রয়েছে। আর দেশ ও জনগণ উভয়ের স্বার্থেই এটি ক্ষতিকর হতে বাধ্য।
সব মিলিয়ে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, দেশে সাধারণ মানুষ তথা মধ্যবিত্তের আয়-উপার্জন ও আর্থিক সক্ষমতা যতোই বাড়ছে, ততোই ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে যাচ্ছে তার চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধের স্তর। আর এতে করে একদিকে যেমন সমাজের গঠন-কাঠামোর গুণগত ও অবনমন ঘটছে, অন্যদিকে তেমনি বাড়ছে সমাজ বিনির্মাণে মেধাবী মানুষদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার ঝুঁকিও। এ অবস্থায় মধ্যবিত্তের বর্ধিত আর্থিক সামর্থ্য যাতে শুধু ভোগের পেছনে ব্যয় না হয়ে চিন্তামুখী কাজেও ব্যয় হয়—সে ব্যাপারে সচেতন মধ্যবিত্তের এগিয়ে আসা উচিৎ বলে মনে করি। স্মরণ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বস্তরের জনগণের ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণ থাকলেও এ ক্ষেত্রে চিন্তার সূত্রপাত, সংগ্রামকে সংগঠিত করা ও সফল নেতৃত্বদানের কাজটি কিন্তু এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অগ্রসর চিন্তা ও মূল্যবোধের ফসল। লেখক : পরিচালক (সিডিসি), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সি। ধঃশযধহ৫৬@মসধরষ.পড়স