বেকারত্ব, রাষ্ট্র ও মোটিভেশনাল আফিম
মারুফ ইসলাম : ইদানিং সভা-সেমিনারগুলোতে কান পাতলে সবচেয়ে বেশি যে বক্তব্য কর্ণগোচর হয় সেটা হচ্ছে ‘আমাদের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি তরুণ। এই তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এদের হাত ধরেই গড়ে উঠবে আগামীর বাংলাদেশ।’ প্রশ্ন হচ্ছে, তাদেরকে যদি কাজের সুযোগই না দিতে পারেন, তবে কীভাবে তারা বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে? মাস দুয়েক আগে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা প্রায় চার কোটি আশি লাখ। এই বিশাল জনগোষ্ঠী একটি কর্মের আশায় কি না করছেন! ভোরবেলা পাবলিক লাইব্রেরির সামনে গেলে দেখা যায় তাদের কর্মযজ্ঞের কিছুটা চিত্র। নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোর সামনে দেখা যায় কিছুটা। এবং শুক্রবার চাকরির পরীক্ষার দিনে কিছুটা দেখা যায় লোকাল বাসের ভিড়ে।
এই বিপুল তারুণ্য বাড়ি-গাড়ি চাইছেন না, অর্থ-সম্পদ চাইছেন না, বেকার ভাতাও চাইছেন না—তারা শুধু কাজ চাইছেন সংশ্লিষ্টদের কাছে। উপায়ন্তর না পেয়ে তারা মাস কয়েক আগে রাজপথে নেমেছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার আন্দোলনসহ নানা কিছু করেছেন তারা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তাদের এসব শোনার সময় নেই। তাঁরা দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ব্যাংক বাঁচাতে ব্যস্ত। যারা ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া বানালেন, যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুট করে দেশের টাকা বাইরে পাচার করলেন, তাদের দায়মুক্তি দিতে ব্যস্ত। আর প্রতিদিন নিয়ম করে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে গিয়ে ‘তরুণরাই বদলাবে দেশ’ এমন মুখস্ত ভাষণ দেয়াতে ব্যস্ত।
এই বিপুল সংখ্যক তরুণকে কর্মসংস্থানের বাইরে রেখে ক্রমাগত তারুণ্যের বন্দনা গাওয়া এক ধরনের ধাপ্পাবাজি। এটি নিঃসন্দেহে মোটিভেশনাল আফিম বৈ অন্য কিছু নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতারা ও রাষ্ট্রযন্ত্র কেন মোটিভেশনাল আফিম ছিটায় সর্বক্ষণ। এটি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে নজর দিতে হবে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার ওপর। রাষ্ট্রের অভ্যুত্থান বা রাষ্ট্র গড়ে ওঠার ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা স্বীকার করবেন যে, আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের গোষ্ঠী সম্পত্তির ওপর গায়ের জোরে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই তাকে রক্ষার স্বার্থে মালিক শ্রেণিকে যে শাসনের ও শোষণের শক্তি গড়ে তুলতে হয়েছিল তাই কালক্রমে বিকাশলাভ করতে করতে আজকের আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে।
তারপর রাষ্ট্রের নানা রিফর্ম হয়েছে। নাম বদলেছে, খোলস বদলেছে, কখনো কখনো মুখোশ পড়েছে রাষ্ট্র। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র ইত্যাদি নানা নাম ধারণ করলেও সবকিছুর আড়ালে রাষ্ট্র মূলত তার শোষনই জারি রেখেছে। ফলে সমাজে দেখা যায় দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি। এক. শোষক ও দুই. শোষিত। যারা শোষিত মানুষ, জ্ঞান বিজ্ঞানের যথার্থ চর্চা যুগে যুগে তারাই করেছে। শাসকরা শোষন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, তাদের যুদ্ধপোকরণ এবং রাষ্ট্রের নিপীড়নযন্ত্রগুলোকে আরও শক্তিশালী করার জন্য, তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের মালামাল আমদানি-রপ্তানির জন্য এবং মাতবরির জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই জ্ঞানচর্চা করেছে।
ফলে আমাদের তারুণ্যের চিৎকারে কর্ণপাত না করা এবং কর্তাদের উন্নাসিকতা বিষয়টিকে দেখতে হবে একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে কোন শ্রেণি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন—অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রধানত কোন শ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। এরসঙ্গে বুঝতে হবে সেই দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, অর্থাৎ ধাঁচটি কী ধরনের; প্রকৃতিই বা কী?
বাংলাদেশে এখন চলছে লগ্নিপুঁজির কাল। অর্থনীতির ছাত্র নই, তারপরও অর্থনীতির এই কঠিন টার্ম সম্পর্কে যতটুকু বুঝি তা হচ্ছে, শিল্পপুঁজি ও ব্যাংকিং পুঁজির মার্জারের (মিলনের) মধ্য দিয়ে লগ্নিপুঁজি তৈরি হয়। লগ্নিপুঁজি জন্ম দেয় ফিনান্সিয়াল অলিগার্কি (লগ্নিকারী ধনকুবের) যারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়, কিন্তু তারাই নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট, স্টক এক্সচেঞ্জ সর্বোপরি জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন।
এই দৃশ্য এখন আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান। আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের পুঁজিবাদ ইতিমধ্যে সা¤্রাজ্যবাদী চরিত্র ধারণ করেছে। এই সা¤্রাজ্যবাদ যদিও ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে দুর্বল, কিন্তু লগ্নিপুঁজির অর্থই হচ্ছে সা¤্রাজ্যবাদ। যেমন আমেরিকা বা বৃটেন আমাদের দেশে যে পুঁজি খাটায় তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এদেশের শ্রমশক্তি ও কাঁচামাল ব্যবহার করে এখান থেকে মুনাফা লুটে নিয়ে নিজেদের দেশের পুঁজিপতিদের পেট মোটা করা। আমাদের দেশের বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানিগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তারা এদেশের প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে যাচ্ছে নিজের দেশে।
আমাদের দেশের কোনো কোনো এনজিও বিদেশে বিশেষ করে আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোতে পুঁজি খাটাচ্ছে, তা কি দেশের উত্তরবঙ্গে কম্বল বিতরণের জন্য? নাকি ওই সকল দেশের সস্তা শ্রমশক্তি ও সস্তা কাঁচামাল ব্যবহার করে মুনাফা লুটে এনে নিজেদের পকেট স্ফীত করার জন্য? কাজেই, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তাদের ধন এই প্রক্রিয়ায় স্ফীত হচ্ছে।
এখন জিজ্ঞাস্য বিষয় হচ্ছে, দেশের বাজার লুন্ঠন করে এবং বিদেশে পুঁজি রপ্তানি করে যে পরিমাণ পুঁজি সঞ্চয় হচ্ছে তা দিয়ে কী দেশের মধ্যে নতুন নতুন উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে? দেশের শিল্পোন্নয়নে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে কি? বেকার সমস্যার সমাধান হচ্ছে কি? না, হচ্ছে না। কিন্তু টাকা বাড়ছে তো! জিডিপি বাড়ছে তো! সম্পদ বাড়ছে তো! সেটা বাড়ছে তাহলে কার পকেটে? লগ্নিকারী ধনকুবেরদের পকেটে।
ফিরে যাই বিবিএসের রিপোর্টে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতে কাংক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না কেন? আমাদের রাষ্ট্রে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু আছে, তার কারণে বিনিয়োগ বাড়ছে না। উল্টোদিকে শোষণ হচ্ছে। সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাৎ করছে ব্যাংকের রাঘববোয়ালরা। এরূপ অবস্থায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে বাধ্য; দেশের মানুষের সত্যিকার আয় কমে যেতে বাধ্য। আর যদি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে থাকে তাহলে ক্রমাগত শিল্পোদ্যোগের পথে পা বাড়ানো কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। আর যদি তা নয় হয়, তবে কৃষির আধুনিকীকরণ ও যন্ত্রীকরণ করা সম্ভব হবে না এবং গ্রামীণ জীবনের দারিদ্র ও দুর্দশা কোনোক্রমেই ঘুচবে না। তাহলে এইরূপ অবস্থায় মানুষ কাজ পাবে কোথায়? কে তাদের কাজ দেবে? বসিয়ে বসিয়ে কেউ বেতন দিতে পারে না, না ব্যক্তিগত মালিক, না রাষ্ট্র।
সুতরাং একদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ বন্ধ, অপরদিকে রাষ্ট্রীয় শোষণ—এই দুইয়ে মিলে যে যাঁতাকল তৈরি হয়েছে তার নিচে পড়ে বেকার তরুণরা নিষ্পেষিত হবেন আরও অনেক বছর, সে কথা হলফ করেই বলা যায়।
লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
সধৎঁভ১৯০২@মসধরষ.পড়স