
১২ কোটি মানুষের মহাসমাগমে শুরু হলো কুম্ভমেলা

প্রকৌশলী প্রাঞ্জল আচার্য্য : ‘কুম্ভের মেলা’ শব্দটি শুনলেই মনের মধ্যে একটি বড়সড় কলসীর চিত্র ভেসে উঠে। হ্যাঁ, সনাতন ধর্মীয় পুরাণ অনুসারে দেবতা ও অসুরদের মিলিত প্রয়াসে যে সমুদ্র মন্থন করা হয়, তাতে একসময়ে অমৃতপূর্ণ একটি কলস ভেসে উঠে এসেছিল। সেকথাটিই এখন বলবো। কুম্ভের মেলাটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। প্রায় ১২ কোটি লোক ভারতের এলাহাবাদের গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এই তিন নদীর সংঙ্গম স্থলে (যা প্রয়াগ নামে খ্যাত) মাসব্যাপি কুম্ভের মেলায় পূণ্যস্নান উপলক্ষ্যে সমবেত হন। এখানে মেলা উপলক্ষ্যে ভারতের পূণ্যার্থীসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন পূণ্যস্নানের জন্য আসেন এবং পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ একসাথে স্নান করতে পারেন। মেলা উপলক্ষ্যে সেখানে সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে একটি শহর নির্মাণ করা হয়। যেখানে পানি, বিদ্যুৎ, খাবার, বিশ্রাম, শৌচাগার, পুলিশ কেন্দ্র, অগ্নি নির্বাপন, যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রায় সকল ধরনের সেবার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের বাণী, উপদেশ প্রচার করা এবং প্রার্থনা সভারও আয়োজন থাকে।
এবার জানা যাক, কেন এই মহামিলনের আয়োজন করা হয়। পুরাণ অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে অমৃত উদ্ধার করতে দেবতা ও অসুরেরা মিলে সমুদ্রমন্থন করেছিলেন। সমুদ্রমন্থনের মন্থনদ- হিসেবে মন্দার পর্বত ও মন্থনদড়ি হিসেবে বাসুকি নাগকে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশাল মন্দারপর্বত যেন সমুদ্রে ডুবে না যায় সে জন্য দেবতারা শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে বিষ্ণু কুর্মঅবতার রূপ গ্রহণ করে তাঁর পিঠে মন্দার পর্বতকে ধারণ করেন। দেবতারা বাসুকির লেজের দিক ও অসুরেরা বাসুকির সম্মুখ দিক ধরে সমুদ্র মন্থন শুরু করেন। এক পর্যায়ে মন্দার পর্বতের সাথে বাসুকি নাগের শরীরের ঘর্ষণের ফলে বাসুকি প্রচ- গতিতে বিষাক্ত নিশ্বাস ছাড়তে থাকে। তাতে চারিদিক বিষাক্ত মেঘে ছেয়ে যায় এবং গাছে গাছে আগুন লেগে যায়। চারিদিকে প্রলয়কা- দেখা দেয়। পরবর্তীতে জীবজগৎ রক্ষাকল্পে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় সবকিছু স্বাভাবিক হয়। তখন সমুদ্রমন্থন আবার শুরু হয়। মন্থনে প্রথমে উঠে আসে হলাহল নামক বিষ। তখন জগতের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে দেবাদিদেব মহাদেব সেই বিষ নিজকণ্ঠে ধারণ করেন। তারপর মন্থনের ফলে একে একে উঠে আসে চন্দ্র, ঐরাবত হাতি, উচ্চশ্রবা ঘোড়া, পারিজাত পুষ্পের বৃক্ষ, উর্বশী, মেনকা ও রম্ভা নামক অপ্সরাগণ, বিভিন্ন রতœসম্ভার। তারপর ধন্বন্তরী অমৃত কুম্ভ নিয়ে উঠে এলেন। অবশেষে স্বর্গমর্ত্য আলোকিত করা রূপে লক্ষ্মীদেবী উঠে এসে বিষ্ণুর সাথে মিলিত হলে, বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করেন এবং মন্থনে উঠে আসা কুম্ভ থেকে দেবতাদের মধ্যে অমৃত ভাগ করে দিতে থাকেন। তখন চার ফোঁটা অমৃত পৃথিবীর চারটি স্থানে পড়ে যায়। ফলে অমৃত পতন স্থানগুলি পরিণত হয় মহাতীর্থে। অমৃতপতন স্থান গুলি হলো- মহারাষ্ট্রের নাসিক ভ্যালি, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী ও এলাহাবাদের গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এই তিন নদীর সংঙ্গম স্থল- যা আজ মহাতীর্থে পরিণত হয়েছে।
জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে চন্দ্র, সূর্য কোন রাশিতে অবস্থান করছে তার উপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করা হয় চার কুম্ভের মধ্যে কোথায় কখন মেলা অনুষ্ঠিত হবে। যে বছর বৃহস্পতি গ্রহ ও সূর্য, সিংহ রাশিতে অবস্থান করেন সে বছর মহারাষ্ট্রের ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দির ঘাটে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করলে, সেই বছর হরিদ্বারে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সূর্য বৃষ রাশিতে অবস্থান করলে সেই বছর উজ্জয়িনীতে মেলার আয়োজন করা হয়। যে বছর বৃহস্পতি বৃষ রাশিতে ও সূর্য কুম্ভ রাশিতে অবস্থান করেন, সেই বছর এলাহাবাদের ত্রিবেণী সংগম প্রয়াগে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি ছয় বছর অন্তর অর্ধকুম্ভ, বার বছর অন্তর পূর্ণকুম্ভ এবং একশত চুয়াল্লিশ বছর অন্তর মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব থেকেই জ্যোতির্বিদ্যার গণনার মাধ্যমে কুম্ভের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এবছর অর্ধকুম্ভ হিসেবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই মহাপবিত্র কুম্ভে স্নান করলে মানব জীবনের সমস্ত পাপ তৎক্ষণাৎ দূর হয়ে যায়।
লেখক : উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, ডিপিডিসি এবং ভক্তিশাস্ত্রী, মায়াপুর ইনস্টিটিউট অব হায়ার স্টাডি, ইসকন, ঢাকা।
