নির্বাচনব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর করতে ৬ দফা সুপারিশ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ হলেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ হয়নি : টিআইবি
স্বপ্না চক্রবর্তী : সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা গেলেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ বলা যায় না বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। নির্বাচন ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর করতে ৬ দফা সুপারিশ দেয় সংস্থাটি।
গতকাল মঙ্গলবার টিআইবির ধানমন্ডি কার্যালয়ে ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। গবেষক দলের অপর সদস্যরা হলেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি, তাসলিমা আক্তার, বিশ^জিৎ কুমার দাস এবং অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কোনো কোনো কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। যেমন সংসদ না ভেঙ্গে নির্বাচন করায় সরকারের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং নির্বাচনমুখী প্রকল্প অনুমোদনসহ নির্বাচনের প্রায় একবছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণা; বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া, সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়ার পরও নির্বাচনের সময় পর্যন্ত ধরপাকড় ও গ্রেফতার অব্যাহত রাখা এবং সরকারবিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদানসহ প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও সহিংসতা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। সবগুলো আসনেই নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা এককভাবে সক্রিয় ছিলেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০টির মধ্যে ৩৬টি আসনে বিরোধীদলের প্রচারে বাধা দানসহ ৪৪টি আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসন কর্তৃক হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী ও নেতা-কর্মী গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মী কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে ভয়-ভীতি দেখানোর তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৯টি আসনে সহিংসতাসহ প্রার্থীদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মারামারি, সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতা-কর্মীদেরকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা, পুড়িয়ে দেয়ার চিত্র দেখা গিয়েছে। প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সার্বিকভাবে তফসিল ঘোষণার পূর্ব থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীদের গড় ব্যয় ৭৭,৬৫,০৮৫ টাকা, যা নির্বাচন কমিশন দ্বারা নির্ধারিত ব্যয়সীমার (আসনপ্রতি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা) তিনগুণেরও বেশি। প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা (গড়ে পাঁচগুণের বেশি) এবং সবচেয়ে কম ব্যয় করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যেভাবে এবারের নির্বাচনটা পরিচালিত হয়েছে তাতে প্রচুর ত্রুটি ছিল। তাই আমরা আশা করবো নির্বাচন কমিশন এই ত্রুটিগুলো দেখে, এই ত্রুটিগুলোর সত্যাসত্য বিচার করে পরবর্তী যে নির্বাচগুলো হবে সেগুলোতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয় সে চেষ্টাই করবেন। কারণ আমরা দেখতে চাই, সত্যিকার অর্থেই জনগণের পছন্দের মানুষেরাই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন।
এসময় নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর করতে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে ৬ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। সেগুলো হলো : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বহুমুখী আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগসমূহ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ব্যর্থতা নিরূপণ করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে এবং এক্ষেত্রে কমিশনের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে; নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করার মাধ্যমে সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে; দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ হতে হবে; নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ ডিজিটালাইজ করতে হবে এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান