কৃষির অগ্রযাত্রা ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন
ম. র. ম. আবদুল্লাহ
এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আর সে দেশটি আজ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে নিজেকে উত্তরণ ঘটিয়েছে। যে তিনটি সূচকে নির্ধারিত মান অর্জন করে এ সাফল্য এসেছে তা হচ্ছে মাথা পিছু আয়, মানব সম্পদের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলা করার ক্ষমতা। গত এক দশক ধরে আমাদের অর্থনীতির যে ধারাবাহিক অগ্রগতি ঘটেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। আজ স্বপ্ন দেখছি এক সময় আমরা উন্নত দেশে পরিণত হবো ।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো কৃষি নির্ভর। আমাদের দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ২২% আসে কৃষি থেকে এবং মোট শ্রমশক্তির ৪২.৭০% এ খাতে নিয়োজিত আছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, রাস্তাঘাট তৈরি এবং অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাÐের জন্য দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমতে থাকা সত্তে¡ও এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে আজ আমরা খাদ্যশস্য, মাছ-মাংস, ফল-ফলাদিসহ সবধরনের কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদনে বহু দূর এগিয়ে গিয়েছি। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’র প্রধান খাদ্যশস্য চাল উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি এবং বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে আছি। মাছ উৎপাদনেও আমরা বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে পৌঁছেছি। ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে আছে। স্বাদ ও গুণগত মানের দিক থেকেও বাংলাদেশের ছাগলের মাংস বিশ্ব সেরা। প্রতিবেশী ভারত হতে আমাদের দেশে বিশেষ উপায়ে গরু আমদানী বন্ধ হবার পর এবার আমরা গরু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে যাচ্ছি। সবজি উৎপাদনে আছি তৃতীয় অবস্থানে। আলু উৎপাদনে আছি প্রথম দশ দেশের মধ্যে। চা উৎপাদনে এবার আমরা বিশ্বে নবম স্থানে উন্নীত হয়েছি। এর আগে বহু বছর যাবৎ আমরা ১০ম ও ১১তম স্থানে ওঠানামা করছিলাম। ১৯৮৯ সালে ছিলাম ১২তম স্থানে। আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল উৎপাদনে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয়, প্রিয় ফল আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) তথ্যানুযায়ী বিগত দশক ধরে ১১% হারে বাংলাদেশের ফল-ফলাদির উৎপাদন বেড়ে চলেছে ।
কৃষি খাতে এই যে ব্যপক অগ্রগতি তা সম্ভব হয়েছে আমাদের দেশের কৃষকদের নিরলস পরিশ্রম, বর্তমান সরকারের বহুমুখী কৃষিবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়ন আর আমাদের দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু এবং রোগ বালাই প্রতিরোধী নানা শস্য উদ্ভাবনের কারণে। আমাদের বিজ্ঞানীরা যেমন ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন তেমনি অনেক বিদেশী শাক-সবজি ও ফল-ফলাদি আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগী করে তৈরি করছেন। তাদের গবেষণার সাফল্যের কারণে আজ বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া অনেক দেশীয় মাছ পুকুরে চাষ করা সম্বব হচ্ছে, বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কৃষি ক্ষেত্রে এ অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি যে কৃষক তার জীবন মানের তেমন কোন উন্নয়ন ঘটেনি। এ জন্য কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায়, তার সারা বছরের পরিশ্রমের মূল্য পায় তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যে কৃষিপণ্য বাজার থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে ক্রয় করি অনেক ক্ষেত্রে কৃষক তা মাত্র ১০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়। বহু মধ্যসত্ত¡ভোগী মাঝখানে থাকায় কৃষক তার পণ্যের নায্য মূল্য পায় না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এক দিকে কৃষক যেমন কম মূল্য পেয়ে ঠকছেন তেমনি ভোক্তাও অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে ঠকছেন। এ বিষয়ে প্রায় সব স্তরে নানা আলোচনা হয়েছে কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনও কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কৃষকদের ন্যয্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আমাদেরকে একটি সুষম বাজার ব্যবস্থা অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের যে অগ্রযাত্রা তা আমাদের ধরে রাখতে হবে, সামনে আরো এগিয়ে নিতে হবে। আর তা করতে হলে আমাদের দেশের কৃষকের জীবনমান অবশ্যই উন্নত করতে হবে। যদি আমরা তা পারি তাহলে আমাদের উন্নয়নের গতিও আমরা ধরে রাখতে পারবো। লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়