সরকারি উন্নয়ন কাজে অর্থ সাশ্রয়ে বাস্তবায়নকারী টিমের দক্ষতা ও আন্তরিকতাই মুখ্য
শ্যামসুন্দর সিকদার
ছাত্রজীবনে সক্রেটিস পড়ার পর একটা বিষয় মনকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। বাজারের দোকানীরা যখন পণ্য বিক্রির জন্য পসরা সাজিয়ে বসতেন, তখন তা দেখে সক্রেটিস অন্যদের চাইতে একটু ব্যতিক্রম আচরণ করতেন। অন্যরা সবাই সেই পসরা দেখে বলতেন, কোন কোন জিনিস আমি নিতে পারি ? অথচ সক্রেটিস সেই আকর্ষণীয় পসরা দেখে বলতেন, কোন কোন জিনিস ছাড়া আমি চলতে পারবো ( ডযধঃ ধৎব ঃযব ঃযরহমং ও পধহ ফড় রিঃযড়ঁঃ ) ? ব্যতিক্রম বলেছি এজন্যই।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটা ছিল সক্রেটিসের মিতব্যয়ী চরিত্র বুঝানোর জন্য একটা চমৎকার উদ্ধৃতি।এই বিষয়টি জানার পর আমার মনে একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব পড়েছিল। মনের অজান্তেই যেন অতিরিক্ত কোনো জিনিসপত্র কেনার উৎসাহ পেতাম না। একটা জিনিস থাকলে ভাবতাম – এটা আছে তো, আর কি দরকার ? স্বভাবটা এমন হয় যে অপচয় করাটা আর পছন্দ হতো না।
কর্মজীবনে এসেও এই স্বভাবটা খুব বেশি বদলাতে পারিনি। এজন্য অনেক সময় সহকর্মীদের সঙ্গে কিছুটা অ¤ø-মধুর বিরোধ সৃষ্টি হতো অপচয় রোধ করা নিয়ে। তবে অপচয় রোধ করা সব সময় সম্ভব না হলেও, মাঝে মাঝে সাফল্য দেখেছিলাম।
সরকারি বহু অনুষ্ঠানাদি হয় এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পসহ বহু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, প্রথমে যে পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করা হয় – তা পরে সংশোধন করে বর্ধিত বাজেটসহ সময় বাড়িয়ে অনুমোদন করতে হয়। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাস্তবায়নকারী টিমের কর্মীগন দক্ষ হলে এবং আন্তরিক হলে এবং সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা করে কাজ করলে তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাজেটের অর্থ সাশ্রয় করেই সুসম্পন্ন করা সম্ভব হয়। তবে সেখানে কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা না যায়, তখন কিছু যৌক্তিক কারণেই ‘ওভার হেড কস্ট’ বৃদ্ধি পায়।
২০১১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ভারত যৌথভাবে কবিগুরুর সার্ধশত জন্ম-বার্ষিকী পালন করে। উভয় দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগে সেটি বছরব্যাপী আয়োজন ছিল। তবে উদ্বোধন পর্বটি ছিল খুবই জাঁকজমকপূর্ণ। দু’দেশের অনুষ্ঠানই উদ্বোধন করেছিলেন স্ব-স্ব প্রধানমন্ত্রী (বাংলা সনের তারিখের হিসাবে একদিনের তফাৎ থাকায় ২৫শে বৈশাখ বাংলাদেশে একদিন আগে এবং ভারতে পরদিন উদ্বোধন হয়)। তবে উভয় দেশের অনুষ্ঠানেই দু’দেশের কবি-সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, কন্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, বাচিকশিল্পী এবং সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে সরকারি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল যোগদান করেছিল। ভারত থেকে উপ-রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে মোট ১০৮ জন সদস্য বিভিন্ন পর্বে বাংলাদেশে এসেছিল এবং বাংলাদেশ থেকে পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে মোট ১১৪ জন সদস্য ভারতের অনুষ্ঠানমালায় যোগদান করেছিল। বাংলাদেশের অনুষ্ঠানমালার ভেন্যু ছিল ঢাকায়, শিলাইদহে, পতিসরে এবং সকল জেলায় ও উপজেলায়। ভারতের দিল্লিতে, কলকাতায় জোড়াসাঁকোতে, শান্তিনিকেতনে এবং অন্যান্য জায়গাতে।
বাংলাদেশের অনুষ্ঠানমালা বাস্তবায়ন করার জন্য বেশ কয়েকটি বিষয়ভিত্তিক কমিটি করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোর চাহিদামত প্রাথমিক প্রস্তাবে বাজেট দাঁড়ায় দশ কোটি টাকায়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মিলে তা আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত বাজেট দাঁড় করেছিল ছয় কোটি টাকায়। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, শেষ পর্যন্ত সকল অনুষ্ঠানমালা খুব চমৎকারভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল মাত্র সাড়ে তিন কোটি টাকায়। বাকী আড়াই কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরৎ দেয়া হয়েছিল। এত বড় অর্থের সাশ্রয় সম্ভব হয়েছিল কেবলমাত্র পুরো টিমের দক্ষতায় ও আন্তরিকতায় এবং সুসমন্বয়ের মাধ্যমে।
এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় ঈঁষঃঁৎধষ উরাবৎংরঃু গরহরংঃবৎরধষ ঋড়ৎঁস নামে এশিয়া প্যাসিফিক রিজিয়নের ৪৪টি দেশের সাংস্কৃতিক সম্মেলন, যা কিনা ইউনেস্কোর অনুরোধে বাংলাদেশ হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে আয়োজন করেছিল। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি ছিলো তিনদিন ব্যাপী। এতে ৪৪টি দেশের মধ্যে ৩৪টি দেশের ৮৮ জন বিদেশী প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসে অংশ নিয়েছিল, তম্মধ্যে ২০টি দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রী এবং একটি দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাছাড়া ইউনেস্কোর তৎকালীন ডাইরেক্টর জেনারেল ড. ইরিনা বুকোবা এবং ইউনেস্কোর দুজন পরিচালক এসেছিলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে বিদেশীদের নিকট এবং ইউনেস্কোর প্রশংসা পায়। অন্যভাবে বলা যায় ড. ইরিনা বুকোবা ওই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে ভালভাবে চিনেছিলেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা নিয়ে তিনি ফিরেছিলেন, যার সুফল বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে পেয়েছে। (তবে ওই সম্মেলনের মাধ্যমে প্রদত্ত “ঢাকা ঘোষণা” পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা, জানা নেই। না হলে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দেয়া দরকার)।
উল্লেখ্য, এই সম্মেলনটিও উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ৪ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হলো, এই অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল মাত্র তিন কোটি টাকায়। অবশিষ্ট উদ্বৃত্ত টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দেয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রেও আগের মতই একটি ভাল নেতৃত্ব এবং ভাল টিম ওয়ার্ক ও সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ছিলো এই সাফল্যের ভিত্তি ।
এতো গেল অনুষ্ঠান করে সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি সরকারি অর্থেরও সাশ্রয় করার অভিজ্ঞতার কথা। এবার বলি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কিছু ভাল অভিজ্ঞতার কথা। বিগত দু’বছরে সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তম্মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প এবং দ্বিতীয় সাব-মেরিন ক্যাবল লাইন স্থাপন প্রকল্প ( ঝঊঅ গঊ ডঊ ৫) খুবই উল্লেখযোগ্য, যেখানে প্রকল্পের অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।
অনেকেই হয়তো জানেন, স্যাটেলাইট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বিটিআরসি ।এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের মূল কম্পোনেন্ট স্যাটেলাইট তৈরির কাজটি ফ্রান্সের থেলাস কোম্পানী সম্পন্ন করেছিল নির্ধারিত সময়ের আগেই। তবে উৎক্ষেপণের কাজটিতে বিলল্ব হয়েছে। তার কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ঝঢ়ধপব ঢ এর ঋধষপড়হ ৯ উৎক্ষেপণযান দ্বারা প্রায় একই সময়ে অনেক দেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করায় দীর্ঘ লাইনে পিছে পড়তে হয়। তাছাড়া সময়মত আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় আরো বিলম্ব^ হয়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছি আমরা। বিটিআরসির পাঠানো প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে আরো পরীক্ষা করে এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। মন্ত্রণালয় হতে এবং প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টার সরাসরি তদারকির কারণেই এত বিশাল অঙ্কের অর্থ বাঁচানো সম্ভব হয়েছে ।
অনুরূপভাবে সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানীর কুয়াকাটা হয়ে দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল লাইন স্থাপন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৫০ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এবং এটিতে ৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টার সরাসরি তদারকির কারণে বিটিসিএল এর বাস্তবায়নাধীন এমওটিএন প্রকল্পের তিনটি কম্পোনেন্টর ব্যয় পুনঃযাচাই করে ১২.৬৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে ।
সুতরাং আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, সরকারি উন্নয়ন কাজে বাস্তবায়নকারী টিমের দক্ষতা ও আন্তরিকতাই অর্থ সাশ্রয় করে অপচয় রোধ করা সম্ভব। সে সঙ্গে সততা, সুসমন্বয়, ভাল টিমওয়ার্ক এবং দক্ষ নেতৃত্বের তদারকির মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে সুসম্পন্ন করা যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরকারি অর্থের সাশ্রয় করাও সম্ভব। সেজন্য প্রকল্পের কাজে দেখেশুনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ প্রদানে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া সমীচীন।
লেখক : সাবেক সচিব, ডাক ও টেলিযোগ বিভাগ