আরো কতো বেশি লাভ চাই?
ড. সা’দত হুসাইন
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে, গত বছরের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দাম অনেক কমেছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, চিনি, সয়াবিন তেল, জ্বালানি তেল, কয়লা, লোহা, তুলা, স্বর্ণ, অ্যালুমিনিয়াম, রূপা ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে এসব সামগ্রীর মধ্যে ভোজ্য পণ্য যেমন রয়েছে তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন উৎপাদন সামগ্রী (ওহঃবৎসবফরধঃব মড়ড়ফং) হিসেবে ব্যবহৃত পণ্যও রয়েছে। আমাদের খাদ্য সামগ্রী, অন্যান্য ভোগ্য পণ্য, যন্ত্রপাতির উৎপাদনে উপর্যুক্ত পণ্য বা দ্রব্য সামগ্রী অত্যাবশ্যকীয়।
আমরা উন্মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাস করি। আমদানি-রপ্তানি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার অনেকগুলো দেশেও উৎপন্ন করা হয়, তবে তা দিয়ে দেশের চাহিদা পুরো মাত্রায় মেটানো যায় না। আবার যেসব পণ্য রপ্তানি করা হয় তার একাংশ দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়। উভয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে সে পণ্যের দাম সীমান্তের দাম (ইড়ৎফবৎ ঢ়ৎরপব)-এর ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। এটি অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবণতা। সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজারে, সীমান্ত রেখার ওপারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশীয় বাজারে ব্যবসায়ীরা সে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। তাদের সোজা যুক্তি : রপ্তানি পণ্য হলে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে এখন সে বেশি দাম পাবে। আমদানি পণ্য হলে বিদেশ থেকে এখন বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, ফলে তাকে দেশের বাজারে বিক্রয় মূল্য বাড়াতে হবে। নইলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্যবসায়ীদের কথা যৌক্তিক শোনাচ্ছে সন্দেহ নেই। অসুবিধা হলো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে গেলে ব্যবসায়ীরা দেশের বাজারে পণ্যের দাম কমায় না। পণ্যের দাম যে আন্তর্জাতিক বাজারে কমে গেছে এ কথাটি তারা গোপন রাখে। তবে আজকাল দীর্ঘ সময় ধরে তথ্য গোপন রাখা সম্ভব নয়। নেটের মাধ্যমে খুব সহজে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কতো তা জেনে নেয়া যায়। এবং জনগণকে তা জানিয়ে দেয়া যায়।
আমাদের পত্রিকাগুলো সে কাজই করেছে। দু’একটি পত্রিকা সুন্দরভাবে দেখিয়ে দিয়েছে গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কী হারে কমেছে। তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সীমান্ত পারে পণ্যের দাম কমা সত্ত্বেও ব্যবসায়ী (রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসহ) সম্প্রদায় পণ্যের দাম কমায়নি। ভোক্তার পকেট হাতিয়ে তারা লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে নিয়েছে। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে পেঁয়াজের দাম। পত্রিকার খবরে দেখতে পাচ্ছি যে, হিলি সীমান্তে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি চার থেকে ছয় টাকা। অথচ ঢাকার বাজারে তা ২৫ থেকে ৩০ টাকা। পরিবহন খরচ এবং পথে পথে চাঁদাবাজির টাকা যোগ করলে কোনোক্রমে দাম ৪০০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।
এর আগে ট্যারিফ কমিশন তাদের গবেষণার ফল প্রকাশ করে দেখিয়েছিলো এদেশের ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত পণ্যের ক্ষেত্রে কী বিপুল পরিমাণ লাভ করে। এ ব্যাপারে নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের বাজার ক্ষমতা (গধৎশবঃ চড়বিৎ) সবচেয়ে বড় নিয়ামক। ব্যবসায়ীদের কৌশলগত অবস্থান হচ্ছে যতোক্ষণ পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি বাজার বহন করতে পারবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত পণ্যের দাম বাড়ানো যেতে পারে। এর মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। ভোক্তা যখন দাম বাড়ানোর কারণে কেনা-কাটা কমিয়ে দেবে তখন পণ্যের দাম কমানো হবে।
মুক্ত বাজার অর্থনীতির অজুহাতে আমরা পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি খুব নমনীয়ভাবে দেখি। এ সুযোগে সিন্ডিকেটবাজরা পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে উঁচুস্তরে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়। ভোক্তাদের সংখ্যা অনেক বেশি হলেও তারা অসংগঠিত, অসংহত। ভোক্তা প্রতিরোধ (ঈড়হংঁসবৎ জবংরংঃধহপব) গড়ার সক্ষমতা তাদের নেই। ব্যবসায়ী-বিক্রেতারা এ সুযোগ পুরোমাত্রায় নিয়ে থাকে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টিতে নানারূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তারা নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় রাখে। ভোক্তারা তাই ঠকে যাচ্ছে। আরো বহুদিন তারা এমনিভাবে ঠকতে থাকবে।