অর্থনৈতিক উন্নয়নে চ্যালেঞ্জসমূহ
মোহাম্মদ জামির
আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)। এদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৩৬তম, ২০২৮ সালে ২৭তম এবং ২০৩৩ সালে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। তারা আশা করছে, ২০১৮ থেকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বার্ষিক গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ। তাদের মতে, পোশাক রপ্তানি, ক্রমবর্ধমান প্রবাসী আয়, অভ্যন্তরীণ ভোগ ব্যয় ও সরকারি ব্যয় থেকে ক্রমশ উপকৃত হচ্ছে বাংলাদেশ।
সিইবিআর অবশ্য উল্লেখ করেছে যে, ক্রমবর্ধমান আমদানি চাহিদা বাংলাদেশের সফল রপ্তানি খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে সামাজিক নিরাপত্তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য অর্থ যোগাতে সরকারকে নতুন নতুন খাত থেকে আয় বাড়ানোর পথ খুঁজে বের করার প্রয়োজন পড়বে। ফলে এখন এটা পরিষ্কার যে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে চলেছে ঠিকই তবে দেশটিকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতে, নতুন অর্থমন্ত্রী এএইচএম মুস্তফা কামালের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হলেও, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কঠোর হওয়ার প্রতিশ্রুতির দিয়েছেন তিনি।
এরই মধ্যে বর্তমান অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। সেই সাথে খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বর্তমানে দেশে অনাদায়ী ঋণের হার ১৩ শতাংশ, এটিকে কমিয়ে ৭.৮ শতাংশে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। যদি এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়বে এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো এগিয়ে যাবে। আরো কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়কে সামনে এনেছেন অর্থমন্ত্রী। জানিয়েছেন, যদিও দেশের ২৫ শতাংশ মানুষই এখন মধ্যম আয়ের শ্রেণিতে পড়ে, তারপরও এখন মাত্র ১৫ লাখ মানুষ কর দেয়। নানা কৌশলে কর ফাঁকি প্রতিরোধে, জেলা পর্যায়ের মানুষদেরকেও করের আওতায় আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গণমাধ্যমের সাথে বৈঠকে, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
যাই হোক, অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পারস্পারিক সমন্বয় আরো বাড়াতে হবে। এটি কেবল আমাদের ব্যবসা ও উৎপাদন ক্ষেত্রেই নয়, বরং আমাদের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যেসব বিদেশিরা বিনিয়োগ ও ব্যবসায় আগ্রহী, তাদের বিশ্বাসও ফিরিয়ে আনবে। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে. আব্দুল মোমেনও এই ধরনের কার্যকলাপের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশী বংশদ্ভুত বিদেশি নাগরিকদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনিয়তা উল্লেখ করে, তাদেরকে দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি সফল হতে পারে, তাহলেই ২০১৮ সালের শেষ দিকে আমাদের যেসব নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে ফোর্বস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা বাদ দিতে সক্ষম হবো। যদিও ‘২০১৯ সালে ব্যবসায়ের জন্য সবচেয়ে ভালো দেশের’ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। তারপরও ফোর্বসের তালিকায় প্রতিবেশি দেশগুলোর চেয়ে পিছনে রয়েছে বাংলাদেশ। ১৬১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯ নম্বরে। অথচ সেখানে ভারতের অবস্থান ৬৩ নম্বরে, শ্রীলঙ্কার ৭৮, ভুটান ১০৬ ও পাকিস্তানের অবস্থান ১০২ নম্বরে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও জ্বালানি খাতে উন্নতির কথা স্বীকার করেছে ফোর্বস, কিন্তু একই সাথে এদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল অবকাঠামো, সার্বজনীন দুর্নীতি, বর্তমান আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ধীর বাস্তবায়নের কথাও উল্লেখ করেছে। আর তাই আরও বেশি বিনিয়োগের সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে বেপজা’কে আরো সক্রিয় হতে হবে। বিদেশে চাকরির সুযোগ তৈরির জন্যই শুধু কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো নয়, বরং এদেশে বিনিয়োগের জন্যও দক্ষ কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত (মূল ইংরেজি লেখা থেকে অনূদিত ও ঈষৎ সংক্ষেপিত)