হস্তশিল্পের বাণিজ্যিক প্রসারে বদলে গেছে জামালপুরের গ্রামীণ চিত্র
ফাতেমা আহমেদ : ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে জামালপুর শহরে গড়ে উঠেছে হস্তশিল্পের এক বিশাল জনপদ। এখানে ঘরে ঘরে কাপড়ে সুঁচ ফুটিয়ে নিপুণ হাতে কারুকাজ খচিত পণ্য তৈরি করছেন নারীরা। এলাকার প্রায় সব ঘরই এই পণ্য তৈরির কারখানা। এ শহরের মহল্লায় মহল্লায় চোখে পড়বে সারি সারি হস্তশিল্পের দোকান। শহরে চলার পথে রাস্তার দু’ধারে শোরুমে নারী বিক্রেতাদের হস্তশিল্প পণ্য বেচাকেনার দৃশ্য মিলবে দু’কদম পর পর। হস্তশিল্পে জড়িত স্বাবলম্বির সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। পরিবর্তন ডটকম
বন্যা ও নদীভাঙন কবলিত দরিদ্র এ জেলায় বেকারত্ব ঘুচাতে বিশেষ ভ‚মিকা রেখেছে এই শিল্প। এ অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতেও গতি এনে দিয়েছে এই শিল্প। জামালপুরের হস্তশিল্পের পণ্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশে খ্যাতি অর্জন করে পরিচিতি পেয়েছে বিদেশেও। এখন বিদেশে রুপ্তানি হচ্ছে এ শিল্পের পণ্য। হস্তশিল্পে এ জেলার বেকার নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় লাভজনক এ পেশায় ঝুঁকছেন পুরুষরাও। এখন হস্তশিল্পের ব্র্যান্ডিং জেলা জামালপুর।
এক সময় জামালপুরের গ্রামীণ বিয়ে-সাদীতে অনিবার্য ছিল নকশী কাঁথা। নববধূর শ্বশুরবাড়ি যাত্রায় বাবার বাড়ি থেকে নকশী কাঁথা নেয়ার রেওয়াজ ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসছে এ অঞ্চলে। সময়ের সাথে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই নকশী শিল্প আবার জেগে উঠেছে জামালপুর জেলাজুড়ে।
নকশী সুঁচিশিল্পের বাণিজ্যিক প্রসারে দরিদ্র এই অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। জেলায় অসংখ্য দরিদ্র নারী জড়িয়ে আছে এই শিল্পের সাথে। কিন্তু বিপণন সমস্যা আর পুঁজির অভাবে তারা বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমের ন্যায্য পাওনা (মজুরি) থেকে।
প্রায় হারিয়ে যেতে বসা গ্রামীণ নকশী সুঁচিশিল্পের বাণিজ্যিক প্রসার জামালপুরে শুরু হয় আশির দশকের শুরুর দিকে। বর্তমানে জামালপুর সদরসহ পুরো জেলায় প্রায় ২৫ হাজার দরিদ্র নারী এই পেশায় জড়িত। এতে স্বাবলম্বি হয়ে উঠছে অনেক হতদরিদ্র নারী। সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি তারা ঘরে বসেই নকশী কাঁথা, নকশী চাঁদর, পাঞ্জাবী, ফতুয়া, কটি, ওয়ালম্যাট, কুশন কভার, শাড়ির নকশী পাড়, থ্রিপিস ওড়নাসহ নানা রকম নকশী সামগ্রীর সুঁচিকর্ম করছে।
এছাড়াও বাড়তি আয়ের জন্য অনেক শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিনীরাও জড়িয়ে পড়েছে এ শিল্পের সাথে। শহরের পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠেছে এ শিল্পের অসংখ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। পুরনো ঐতিহ্য ও নকশা অনুসরণ করে গ্রামীণ নারীরা সুঁচ, সুতা-রঙের সমন্বয়ে কাঁথাসহ এসব দ্রব্যে নানা সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে তাদের নিপুণ হাতে।
জামালপুরের নকশী পণ্যের কদর বাড়ছে দেশে-বিদেশে। জেলা শহরেও রয়েছে এ শিল্পের ছোট-বড় অনেক শো-রুম। কিন্তু বিপণন সমস্যা , সরকারি পৃষ্টপোষকতা আর পুঁজির অভাবে শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার নারীকর্মীরা। ইচ্ছে মতো মালিকের দেয়া অল্প মজুরিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের।
আর স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, একটি নকশী কাঁথা তৈরি করতে মজুরিসহ খরচ হয় ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা । ঢাকার পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করতে হয় ২০০০ টাকায় । এই কাথা ঢাকার বড় বড় বিপণী বিতানগুলোতে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায়। পূঁজির অভাবে তারা নিজেরা বাজারজাত করতে পারছেন না এসব পণ্য। ফলে পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে নিজেরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনী যথাযথ শ্রমমূল্য পাচ্ছে না নারী শ্রমিকরা।
মেলান্দহ উপজেলার নয়ানগর ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামের জেসমিন আলম বলেন, ‘এক সময় গৃহিনী ছিলাম। স্বামী সামসুল আলম ব্যবসায় লস খাওয়ার পর বেকার হয়ে পড়ে। সংসার ঋণের চাপে পড়ে অভাব অনটন দেখা দেয়। সংসারে যোগান দিতে হস্তশিল্পের কাজ শুরু করি। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পর এলাকার বেকার নারীদের নিয়ে মৌচাক নামে সংগঠন গড়ে তুলি। সেখানে হস্তশিল্প ও কাপড় সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দিয়েছি ৬শ বেকার নারীকে। তারা এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে হস্তশিল্পে জড়িয়ে আয় করে সংসারে যোগান দিচ্ছে। মেলান্দহ বাজারে শাপলা মার্কেটে মৌচাক মহিলা অঙ্গন নামে হস্তশিল্প পণ্যের শোরুম দিয়েছি। জাতীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতা ও জাতীয় শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছি। বেকার নারীদের আহ্বান করছি হস্তশিল্পের পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে। ঘরে বসে না থেকে অলস হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করলে সাফল্য আসবেই।’
হস্তশিল্প এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, ‘আমাদের স্বপ্নের নকশীপল্লী গড়ে উঠলে উদ্যোক্তাদের মধ্যে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা আসবে। দূর হবে হস্তশিল্পকর্মীদের পণ্য বাজারজাত সমস্যা । দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ীরা নকশীপল্লীতে আসবে পছন্দের পণ্য কিনতে।’
দেশের বাইরেও এসব পণ্যের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। রফতানি করতে পারবে বিদেশেও। দেশের গার্মেন্টশিল্পের পরেই জামালপুরের হস্তশিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ তৈরিতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন হস্তশিল্প সংশ্লিষ্টরা।
সরকার হস্তশিল্পের ব্যান্ডিং জেলা হিসেবে জামালপুরকে ঘোষণা করেছে। শিল্পটি প্রসারে জামালপুরে নকশীপল্লী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে জামালপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আহমেদ কবীর বলেন, ১শ ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নকশী পল্লীর স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ একনেকে পাসের অপেক্ষায় দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হস্তশিল্পজাত পণ্যের বাজার ব্যবস্থা, বিদেশি উদ্যোক্তাদের থাকার ব্যবস্থাসহ নানা ব্যবস্থা থাকছে নকশীপল্লিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে হস্তশিল্পে গতি এসে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
হস্তশিল্প পণ্যের নিজস্ব বাজার গড়ে উঠলে হতদরিদ্র নারী শ্রমিকরা একদিকে যেমন তাদের সঠিক শ্রমমূল্য পাবেন, পাশাপাশি দরিদ্র এ জেলায় গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রও পাল্টে যাবে।