ড. শফিক উজ জামান বললেন, পাটের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও এখনো তা কাজে লাগানো যায়নি
স্মৃতি খানম : ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক, অধ্যাপক ড. শফিক উজ জামান বলেছেন, গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত পাট ছিলো প্রধান রপ্তানি পণ্য। এরপর পোশাক পাটের স্থান দখল করে এবং রফতানির চার-পঞ্চমাংশের জোগান দিয়েছে। পাটের বিপুল সম্ভাবনা এখনো কাজে লাগানো যায়নি। আমরা দেখেছি বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহের সময়, বিশেষ করে ধ্বংসাত্মক বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুর গোলার আঘাত থেকে বাঁচার জন্য পাট ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু পাট আর যুদ্ধে ব্যবহৃত পণ্য নয় বরং মহাযুদ্ধের চেয়েও শক্তিশালী ধ্বংসাত্মক পলিথিন ও প্লাস্টিকের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর অন্যতম উপাদান হিসেবে পাটপণ্যের ডাক এসেছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে পাটপণ্যের চাহিদা হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো সস্তা ও সহজলভ্য প্লাস্টিক ও পলিথিন। কিন্তু এক দশক পরেই এ দুটি পণ্যের ভয়ংকর ক্ষতিকর দিকটি জানতে পেরে মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে। সূত্র: সমকাল
তিনি আরও বলেন, এ দুটি অপচনশীল রাসায়নিক পণ্য। প্লাস্টিক কেটেছিঁড়ে টুকরো কিংবা গুড়া করে, এমনকি পুড়িয়ে ফেললেও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিস্তার নেই। পলিথিন পানিতে গলে না, বছরের পর বছর পড়ে থাকলেও পচে না। ফসলের জমিতে পড়ে থাকলে পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সার, পলিমাটি আটকে রাখে। তেমনিভাবে নদী-খাল-বিলে পলিথিন স্তূপাকারে জমা হলে তার ওপর পলি পড়ে নদীর গভীরতা হ্রাস করে, মাছের চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং প্রজনন হ্রাস পায়। প্লাস্টিকের আগ্রাসন থেকে সমুদ্রও দূষণমুক্ত নয়। সম্প্রতি ইউরোপে সামুদ্রিক মৎস্য শিকারিদের জালে ধৃত মৃত তিমিসহ বেশ কিছু সামুদ্রিক মাছ পাওয়া গেছে। এসব মাছের পেটে বিপুল প্লাস্টিক ও পলিথিন পাওয়া যায়। গবেষকরা এই অপচনশীল পণ্যই তিমির মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রাণিকুল বিনাশ ও পরিবেশ ধ্বংসকারী উপাদান থাকার কারণে গত শতাব্দীর আশির দশকেই ইউরোপে প্রাণঘাতী এবং পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো। কোনো কোনো শহরে ‘প্লাস্টিকের বদলে পাট’ স্লোগান দিয়ে তরুণ-তরুণীরা পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নেমে পড়ে। ইউরোপের এই আন্দোলন বিশ্বের অপরাপর উন্নত দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এহেন পলিথিনবিরোধী আন্দোলনের সুযোগ গ্রহণ করে ভারত ও চীন। এ দুটি দেশ বৈচিত্র্যময় পাটপণ্য তৈরি করে রপ্তানি বাজার দখল করে। পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের চাহিদার ঊর্ধ্বগতির সময় ২০০২ সালে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেয়া হয়। অথচ সে সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বিশ্বব্যাংক ৯টি পাটকল স্থাপনে অর্থ সহায়তা দিয়েছিলো। আদমজী বন্ধ করার আগে একনাগাড়ে প্রচার চালানো হয়েছে- আদমজীর লোকসানের টাকা দিয়ে কয়েকটি যমুনা ব্রিজ করা যাবে, কয়েকটি উন্নয়ন বাজেট করা যাবে।
আদমজীকে বলা হয়েছে সানসেট ইন্ডাস্ট্রি বা ডুবন্ত শিল্প। কেউ বলেছে, মরা লাশ। কিন্তু আদমজী আদৌ লোকসানি কিনা, আর তা হলে এর জন্য দায়ী কে- এসব প্রশ্ন তোলাও ছিলো অপরাধের শামিল। ২০০২ সালে যখন আদমজী বন্ধ করা হলো, তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা আদমজী বন্ধ করার মতো ‘সাহসী’ পদক্ষেপের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন।
আজ বিশ্বের সর্বত্রই পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ছে এবং দেরিতে হলেও বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী পাটের জিনগত বৈশিষ্ট্য আবিষ্কারের মাধ্যমে তুলার মতো মিহি সুতা আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের আকস্মিক মৃত্যুর পর তারই সহকর্মী বিজ্ঞানীরা পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট থেকে পলিব্যাগ আবিষ্কার করেছেন। পলিব্যাগ পলিথিনের মতোই হালকা, সহজে বহনযোগ্য ও পচনশীল। পলিব্যাগ উৎপাদন এখনও সীমিত আকারে হলেও এই পণ্য পূর্ণরূপে পরিবেশবান্ধব বলে শুধু প্লাস্টিকের আগ্রাসন থেকে দেশই রক্ষা পাবে না, পোশাকের পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।