বাংলাদেশ কেন পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে
পারভেজ হুডভয় : এটা সত্য যে বাংলাদেশ স্বর্গীয় কোন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নয়। বাংলাদেশ গরীব, জনবহুল, আর সেখানে গণতন্ত্র যে কতটা হাস্যকর পর্যায়ে রয়েছে সেটা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনেই প্রকাশিত হয়েছে। দেশটি দুর্নীতিপরায়ণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। মাঝে মাঝে সেখানে জঙ্গি হামলাও হয়।
এতকিছুর পরও অনেক অর্থনীতিবিদই বলছেন, আগামীতে এশিয়ার বাঘ হতে যাচ্ছে এই বাংলাদেশই। তারা এসব বলছেন অর্থনীতির কিছু সূচকের তুলনা করেই। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার গতবছর ছিল ৭.৮ শতাংশ। এটা ভারতের (৮ শতাংশ) চেয়ে সামান্য কম, এবং পাকিস্তানের (৫.৮ শতাংশ) চেয়ে অনেকটাই বেশি। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ এখন মাথাপিছু ৪৩৪ ডলার। এটা পাকিস্তানের (মাথাপিছু ৯৭৪ ডলার) অর্ধেকের চেয়েও কম। আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তানের একেবারে চারগুণ, বাংলাদেশের রিজাভ ৩২ বিলিয়ন ডলার আর পাকিস্তানের ৮ বিলিয়ন ডলার।
অথচ ১৯৭১ সালে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিল এই দেশটি। আজ বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ৩৫.৮ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ২৪.৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানের ১৮০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১ সালে ৩২২ বিলিয়নে উন্নীত হবে।
এতো গেল কেবল অর্থনীতির তুলনা। মানব সম্পদের বিবেচনাতেও বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে পাকিস্তানের তুলনায়। এক সময় এই দু’টি অঞ্চল একই দেশ ছিল। তখনকার, ১৯৫১ সালের হিসাবের দিকে তাকালে দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানের বাংলাদেশ) জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২০ লাখ, আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ। আর এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫০ লাখ, আর পাকিস্তানের জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ কোটিতে। যথাযথ প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ তাদের জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, আর পাকিস্তানে সে প্রচারণা শুরুই করতে পারেনি।
স্বাস্থ্য খাতেও একই দৃশ্য। শিশু মৃত্যুর হার পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে অনেক কম। টিকাদান বাংলাদেশে খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য, পোলিও ড্রপ খাওয়াতে যেয়ে সেখানে কাউকে গুলি খেয়ে মরতে হয়নি। মানুষের গড় আয়ুও বাংলাদেশে (৭২.৫ বছর) পাকিস্তানের (৬৬.৫ বছর) চেয়ে বেশি। আইএলও’র হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীর কর্মসংস্থান (৩৩.২ শতাংশ)ও পাকিস্তানের (২৫.১ শতাংশ) চেয়ে অনেক ভালো।
এখন প্রশ্ন হলো, এক সময় পাকিস্তানের যে অংশ তুলনামূলকভাবে গরিব ছিল, অবহেলিত ছিল, তারা কিভাবে এতটা এগিয়ে গেল? সেখানে তো কোন পারমাণবিক অস্ত্র নেই, শক্তিশালী সেনাবাহিনী নেই, উর্দির ছায়ায় থেকে দেশ শাসনের মতো প্রচুর জ্ঞানী লোক নেই। এমনকি বাংলাদেশের জন্মের সময়ে সেখানে দারুন পেশাদার কোন আমলাতন্ত্রও ছিল না, তারা তখন সাবেক ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের একজনকে মাত্র পেয়েছিল। ১৯৫০-১৯৬০ সময়কালে আমি স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমরা বেড়ে উঠেছিলাম একধরনের বর্ণবাদের মধ্যে, বাঙালিদের তখন হেয় বিবেচনা করা হতো। বলা হতো- ওরা ছোট খাটো, কালো বা শ্যামবর্ণের। আমরা মনে করতাম- প্রকৃত মুসলিমরা হবে ফর্সা, লম্বা এবং তারা চোস্ত উর্দু বলবে। রেডিও পাকিস্তানে যখন বাংলায় সংবাদ প্রচার হতো, আমরা হাসাহাসি করতাম। ভাষা হবে উর্দুর মতো জলদ গম্ভীর পুরুষালী, অথচ বাংলা কি মর্মান্তিক মেয়েলী! তাই দেশ যখন বিভক্ত হয়ে গেল, এদিক থেকে বলা হলো বাংলাদেশ টিকেই থাকতে পারবে না, ক’দিন পরেই অনুরোধ করবে আবার ফিরে আসার জন্য।
কিন্তু পাকিস্তানীদের সেই চিন্তা সত্য হয়নি। বাংলাদেশ কেবল টিকেই থাকেনি, বরং পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে গেছে অনেকটা।
পাকিস্তানকে নিয়ে যারা আশাবাদী ছিলেন, তারা ভেবেছিলেন ১৯৭১ এর ঘটনা থেকে পাকিস্তান শিক্ষা নেবে। বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যে বৈষম্য, সেটা তারা দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না, বরং বৈষম্য আর বঞ্চনা বাড়তেই থাকলো। ১৯৭৩ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো বেলুচিস্তানের ন্যাপ সরকারকে বরখাস্ত করলো, সেখান সেনাবাহিনীকে নামালো। শুরু হলো স্থানীয় বিদ্রোহীদের আন্দোলন। এই বিদ্রোহ দমন করতে ভুট্টো এমন এক বাহিনীকে শক্তিশালী করলো, যারা শেষ পর্যন্ত তাকেই ফাঁসিতে ঝুলালো।
একদা এক থাকলেও আজ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সম্পূর্ণ পৃথক দু’টি দেশ। কেবল তাই নয়, চিন্তা চেতনা এমন জাতীয় স্বার্থ- সব দিক দিয়েই তারা ভিন্ন। বাংলাদেশ তাদের ভবিষ্যত দেখে মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে। তাদের লক্ষ্যে রফতানি বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন, ঋণ ও অনুদানের উপর নির্ভরতা কমানো, ক্ষুদ্র ঋণের বিস্তার। পানি ও সীমানা নিয়ে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তাদের মতবিরোধ রয়েছে, ভারত থেকে আসা মাদক তাদেরকে বিরক্ত করছে, কিন্তু এতকিছুর পরেও মূল লক্ষ্য থেকে তারা সরে যায়নি। বিপরীত দিকে মানবসম্পদের উন্নয়ন পাকিস্তানের জন্য অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। সে তুলনায় তারা বরং সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে- কিভাবে ভারতকে জব্দ করা যায়। ভারতের সঙ্গে নেমেছে সামরিক প্রতিযোগিতায়। এটা করতে যেয়ে আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে এরা সম্পর্ক নষ্ট করেছে। অভিযোগ তুলেছে, এই দুটি দেশ নাকি ভারতের সঙ্গে অধিকতর ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছে।
এতসব করে পাকিস্তানের লাভটা কি হয়েছে? লাভ তো দূরের কথা, বরং পিছিয়েই পড়তে হয়েছে ক্রমাগত। সে কারণেই বলা হচ্ছে, সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে পাকিস্তানকে অবশ্যই তার যুদ্ধ অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করতে হবে শান্তি অর্থনীতিতে।
লেখক : লাহোর ও ইসলামাবাদে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক