পাথরের খনিতে পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখির ফসিল ‘আর্কিওপটেরিক্স’
ইয়াছির আরাফাত
আর্কিওপটেরিক্স একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘প্রাচীন ডানা’, অর্থাৎ পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখির ডানা। ১৮৬১ সালে জার্মানির এক পাথরের খনিতে এই পাখির ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়া যায়। সেখানে মূলত একটি পাখির দুটি বৃহৎ ডানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি। তবে এ নিয়ে বিতর্কও আছে। তবুও প্রতœতাত্বিক ও পাখি বিজ্ঞানীরা অনেকটা একমত যে, আবিষ্কৃত আর্কিওপটেরিক্সই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি। পাখি এক বৈচিত্রময় প্রাণী। একইসাথে সে হাঁটতে ও উড়তে পারে। বিশেষত পাখির উড়তে পারা নিয়ে প্রাচীন মানুষের মাঝে ছিল অসীম কৌতূহল। অনেক সভ্যতায় তাই পাখিকে দেয়া হয়েছে দেবতুল্য সম্মান।
আর্কিওপটেরিক্স পাখি : বাইবেলে উল্লেখ আছে, সাদা সারসের কথা। এই পাখিরা উত্তর ইউরোপ থেকে ইসরায়েলে এসেছিল। ইহুদি ধর্মে সারসকে আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রচন্ড বিপদেও সারসরা একে অপরকে ছেড়ে যায় না। ভাববাদী যিরমিয় ইহুদীরা যখন ঈশ্বর যিহোবার আনুগত্য পরিত্যাগ করেছিল, তখন তাদের সারসের উদাহরণ দিয়ে ধর্মের পথে ফিরে আসার আহŸান জানানো হয়েছিলো। প্রাচীনকালে সাহিত্যের পাতা জুড়েও পাওয়া যায় পাখির বিবরণ। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস কিংবা উপমহাদেশের প্রাচীন কবি বাল্মীকি, কালিদাস, বানভট্ট প্রমুখের কবিতায়ও ছিল পাখির প্রসঙ্গ। বাল্মীকি তার জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন একটি চখাচখি হাঁসের বিরহ বেদনা নিয়ে। কালিদাসের অমর সৃষ্টি মেঘদূতে চাতক, বক, ময়ূর, শালিক, পাহাড়ি ময়না, চখাচখি, নীলকণ্ঠ, গোলাপায়রা প্রভৃতি পাখির বিবরণ উঠে এসেছে। বানভট্টের অপূর্ব সৃষ্টি কাদম্বরী শুরু হয়েছে পম্পা সরোবর তীরের গভীর অরণ্যের বর্ণনা দিয়ে। সেখানে খোঁজ মেলে অসংখ্য পাখির। বিশেষত এক শুকপাখির মুখ দিয়ে তিনি পাখিদের জীবনের মর্মস্পর্শী বিরহ বেদনা তুলে ধরা হয় সেখানে।
আর্কিওপটেরিক্স পাখির কঙ্কাল :
এভাবেই প্রাচীনকালের প্রথা, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতিতে রয়েছে পাখির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি। কিন্তু এই পাখির শুরুটা কীভাবে? অবশ্য কীভাবে বা কখন পাখিরা পৃথিবীতে এসেছিল তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। এ নিয়ে রয়েছে নানা মতবাদও। এ পর্যন্ত পাখির সবচেয়ে প্রাচীন ‘চিত্র’ পাওয়া গেছে স্পেনের এক গুহায়। প্রতœতাত্বিকদের ধারণা, সেগুলো পনের থেকে ষোল হাজার বছর আগের গুহা মানবদের আঁকা। তখনকার দিনে শিকারে যাওয়ার আগে গুহার দেয়ালে পশুপাখির ছবি আঁকার একটি রেওয়াজ ছিলো। আর এ পর্যন্ত পাখির প্রাচীনতম ‘জীবাশ্ম’ পাওয়া গেছে জার্মানির বাভারিয়ার লাইমস্টোন বা কালো পাথরের খনিতে, ১৮৬১ সালে।
আর্কিওপটেরিক্স পাখি : বাভারিয়ার লাইমস্টোন খনিটি ছিলো রাভেগনালথেইম এলাকায়। এরিক হারম্যান ভন মেয়ের নামের এক জার্মান জীববিজ্ঞানী প্রথমে এর সন্ধান পান। তিনি এটি উদ্ধার করে একজন স্থানীয় পদার্থবিদ কার্ল হবারলেইনের কাছে গবেষণার জন্য দিয়ে দেন। তিনি এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে লন্ডনের ইতিহাস যাদুঘরে খবর দেন। লন্ডনের ‘ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম’ কর্তৃপক্ষ ৭০০ ইউরোর বিনিময়ে তার থেকে ঐতিহাসিক এই জীবাশ্মটি কিনে নেন।
আবিষ্কারের পর পাখির এই জীবাশ্ম জীববিজ্ঞানীদের মাঝে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর ফলে পাখিদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানার এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। সেই জীবাশ্মের পাখির মাথা দেখতে গিরগিটির মতো। চোয়ালে রয়েছে সারি সারি দাঁত। মেরুদন্ড অনেকটা গিরগিটির লেজের মতো লম্বা। লেজটা কতগুলো জোড়া দেয়া হাড়ের মতো দেখতে, যার দু’পাশ জুড়ে থাকতো ঘন পালক। এ কারণেই একদল পাখি বিজ্ঞানীর অনুমান, গিরগিটি থেকে বিবর্তিত হয়ে পাখির উৎপত্তি হয়েছে। অনেকে আবার এর সাথে মিল পেয়েছেন ডাইনোসরের। এই আদি পাখির পালক ও হাড়গুলো লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। বিজ্ঞানীরা এই পাখির নামই দিয়েছেন আর্কিওপটেরিক্স। তাদের ধারণা, এর বয়স ১৩ থেকে ১৪ কোটি বছর। তাদের দাবি, এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি।