প্রাচীন মিশর এবং ফারাওদের কিছু অজানা কথা
বাশার আল আসাদ
প্রাচীন মিশরের ফারাওদের ছিল অসীম ক্ষমতা, অফুরন্ত বিত্ত ও অবিশ্বাস্য পদমর্যাদা। শুধুমাত্র এই জীবনেই এসব ভোগ করে তারা তৃপ্ত ছিলেন না। বরং মৃত্যুর পরেও এতসব সুবিধা উপভোগ করার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন একেকজন ফারাও। তাদের সমাধিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই এ ব্যাপারে একটি ভালো ধারণা পাওয়া যায়। কী ছিল না সেসব সমাধিতে! স্নানাগার, বালিশ, খাবার, সুরা থেকে শুরু করে গর্ভধারণরোধী সামগ্রী পর্যন্ত পাওয়া গেছে সমাধিগুলোতে। আর তার সঙ্গে অবশ্যই বহুমূল্যবান অলংকার এবং সোনায় মোড়ানো ফারাওদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র তো ছিলই। কিছু সমাধিতে সোনায় আচ্ছাদিত রথ এবং সুবিশাল নৌকাও পাওয়া গিয়েছে। আসলে ফারাওদের কাছে মৃত্যুর সংজ্ঞা এমন ছিল না যে, আমি চলে যাচ্ছি সবকিছু ছেড়ে। বরং তাদের কাছে মৃত্যু ছিল অনেকটা- “আমি চলে যাচ্ছি সবকিছু নিয়ে” ধরনের! তবে সবথেকে ভয়ানক ব্যাপারটি হলো সমাধিগুলোতে ফারাওদের অসংখ্য ভৃত্যের মৃতদেহ পাওয়া যাওয়া। বিভিন্ন ফারাওয়ের নিষ্ঠুরতা, তাদের অপকর্ম, লাগামহীন যৌনতা এবং জনগণের ওপর তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকছে আজকের নিয়ে লেখা।
ফারাও জায়ারের সমাধি : আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে প্রথমবারের মতো মিশর একটি ঐক্যবদ্ধ একক রাজ্যে পরিণত হয়। এর ফলে তৎকালীন ফারাও জায়ার লাভ করে অসীম ক্ষমতা, যা প্রাচীন পৃথিবীতে আগে কখনো দেখা যায়নি। শাসনকালের কোনো একসময় হয়তো ফারাও জায়ারের মনে মৃত্যুর চিন্তা উঁকি দিয়েছিল। সব কিছু ভেবে-চিন্তে তিনি দেখলেন যে, পরপারে একা একা যাওয়া তার মতো মহান শাসকের জন্য মানানসই নয়। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তার অধীনস্থ দাসদেরকেও নিজের সঙ্গে পরপারে নিয়ে যাবেন! জায়ারের এই ইচ্ছাপূরণের জন্য সেই সময় শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া তারা এক্ষেত্রে নিজেদের সমাধিতে বিভিন্ন প্রাণী, যেমন-পাখি, বিড়াল, বানর,কুমির, সিংহ, বেবুন ইত্যাদির মমি সঙ্গে নিয়েছিল। আর সাথে নিয়েছিল নিজেদের দাসদের।
একটি মমি করা কুকুর : ফারাও জায়ার নিজের জন্য হয়তো বা কোনো নিয়ম নির্ধারণ করেছিলেন যাতে করে মৃত্যুর পর তার সমাধিতে তার ভৃত্যদের মৃতদেহও মজুদ করা হয়। এই ঠান্ডা মাথার নরহত্যার পক্ষে দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় একশত বছর আগে প্রত্মত্বাবিদগণ আবিদোস এর পতিত জমিতে ফারাও জায়ারের নির্মম কর্মকান্ডের প্রমাণ পেয়েছিলেন। তার সমাধি প্রায় ৩১৮টি মৃতদেহ দ্বারা বেষ্টিত ছিল। ফারাও জায়ারের ভৃত্যরা কীভাবে তাদের করুণ পরিণতি বরণ করেছিল তা পরিষ্কার নয়। কারণ তাদের শরীরে কোনো দৃশ্যমান ক্ষত বা ভাঙ্গা হাড় পাওয়া যায়নি এবং তারা সকলেই একই সঙ্গে মৃত্যু বরণ করেছিল। ধারণা করা হয় যে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিল। পাঁচ হাজার বছর পরে আজকের দিনে এই ঘটনা শুধুমাত্র প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের একটি নিষ্প্রাণ অধ্যায় হিসেবেই টিকে আছে।
দ্বিতীয় আমেনহোটেপ : ফারাও দ্বিতীয় আমেনহোটেপ আনুমানিক ১৪২৭ খ্রিস্টপূর্বে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি ছিলেন অষ্টাদশ তম রাজবংশের সপ্তম ফারাও। বিখ্যাত ফারাও তৃতীয় তুত্মোসিস ছিলেন তার পিতা। অষ্টাদশ রাজবংশের সবচেয়ে নৃশংস এবং রক্তপিপাসু শাসক হিসেবে দ্বিতীয় আমেনহোটেপের কুখ্যাতি রয়েছে। তার সমাধি থেকে পাওয়া যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে তিনিও নরবলি সমর্থন করতেন। তার সমাধি থেকে একটি নৌকার সঙ্গে বাধা অবস্থায় মস্তকে ফাটল যুক্ত একজন মানুষের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া সমাধির ভেতরের কক্ষতে পাওয়া গিয়েছে একজন নারী ও একটি বাচ্চার মমি। এ থেকে ধারণা করা হয়, তিনি তার বিশ্বাস মতে দেবতা ওসাইরিসের স্বর্গে তার পরিবারের প্রিয়জনদের নিয়েই থাকতে চেয়েছিলেন।
চলন্ত রথ থেকে তীর ছুঁড়ছেন দ্বিতীয় আমেনহোটেপ : মিশরীয় যোদ্ধাদের সবথেকে প্রিয় অস্ত্র ছিল কুঠার এবং গদা। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় আমেনহোটেপের প্রথম পছন্দ ছিল গদা। তিনি গদা দিয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে খুব জোরে আঘাত করতেন শত্রুদের মাথায়। শত্রু কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু বরণ করত। সিরিয়া অভিযানে তিনি সেখানকার সাতজন গোত্রপ্রধানকে হত্যা করেছিলেন। তাদের দেহ বিজয়স্মারক হিসেবে রণতরীর সম্মুখে লাশের পায়ে রশি বেঁধে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে আসেন। পরে ছয়জন গোত্রপ্রধানের দেহ থিবেসের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল এবং অপরজনকে প্রেরণ করা হয়েছিল নুবিয়ার নাপাতায়। সাতজনেরই মাথা ধড় থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছিল এবং এই কাজ দ্বিতীয় আমেনহোটেপ সম্পাদন করেছিলেন নিজ হাতে! নিজের শত্রুদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী-ই বা হতে পারে।