চা শ্রমিকের জীবন জন্ম জন্মান্তরের দুষ্টচক্রে বাঁধা
বাশার আল আসাদ
চা বাগান, পাহাড়ের ঢালে সাজানো সবুজের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় আমাদের। এই বাগানের পাতা থেকে তৈরি চা আমাদের ক্লান্তি দূর করে, মনে প্রশান্তি দেয়। বাংলাদেশে চা চাষের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ আর পুরাতন। ১৮৫৪ সালে সিলেটে যখন চায়ের বাগান করে চা উৎপাদন শুরু হয় তখন সিংহভাগের দখলে ছিল ব্রিটিশ বণিকরা। মাইলের পর মাইল বিশাল এই চা বাগানে কাজ করবার জন্য দরকার ছিল বিপুল শ্রমিক। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একটি কুড়ি আর দুটি পাতা ছিড়ে শৌখিন মানুষের কাপে চা পৌঁছে দিচ্ছে চা শ্রমিকরা। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়, ভারত ভাগ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু চা শ্রমিকদের ভাগ্য চা বাগানের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির গন্ডিতে বাঁধা পড়ে আছে। বংশানুক্রমে সমাজের মূলধারা থেকে বিছিন্ন এই মানুষগুলোর নিজেদের ভূমির অধিকার নেই, দিনে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা মজুরীর চক্রে বাঁধা এদের জীবন।
লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে মজুরী কাটা যায় : প্রতিটি চা শ্রমিককে দিনে ২৩ কেজি চা পাতা তোলার লক্ষ্য দিয়ে দেওয়া হয়। বাগান বিশেষে হয়তো এই লক্ষ্যটি ১৮ থেকে ২৪ কেজিতে উঠানামা করে। তবে এই লক্ষ্য দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি সিলেটের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য চা বাগানেও আছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে কাটা যায় মজুরী। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে যেমন মজুরী কাটা যায় তেমনি লক্ষ্যের চেয়ে বেশি পাতা তুলতে পারলে প্রতি কেজি পাতার জন্য দুই থেকে তিন টাকা বাড়তি মজুরী দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্যে অর্জনে চা শ্রমিকেরা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাহায্য নেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের শিশু সদস্যদের যুক্ত করা হয়। যে বয়সে শিশুটির সময় কাটানোর কথা ছিল স্কুলের প্রাঙ্গণে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা করে সেখানে দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ির খোঁজ করতেই অস্ত যায় সোনালী সূর্য। তবে, খোলা চোখে চা বাগানে শিশু শ্রমের ব্যাপারটি সেই অর্থে দৃশ্যমান নয়। পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে কাজ করতে করতে চা বাগানের কাজে জড়িয়ে যায় তারা। তবে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগে নিবন্ধিত করা হয় না তাদের। ফলে মালিকপক্ষের কাঁধে শিশুশ্রমের দায় চাপানো যায় না। পরিবারের সদস্যরা কয়েক টাকা বাড়তি মজুরীর আশায় নিজেরাই তাদের সন্তানদের কাজে নিয়োজিত করে থাকেন।
লক্ষ্য অর্জনের জন্য মায়ের সাথে কাজে নামে শিশুরা : চা বাগানের চৌহদ্দিতে মাঝেমধ্যেই দেখা মিলে স্কুলের। ইউনিসেফ কিংবা অন্য কোনো দাতব্য সংস্থার স্কুলের রঙিন দালানগুলো দূর থেকে ডাকতে থাকে শিশুদের। চা শ্রমিকদের অনেকেই এখন স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানেরা চা বাগানের বাইরে পা রাখবে। কিন্তু সেই আশা অনেক সময় ধোঁয়ার মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়। প্রাথমিক কিংবা প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা হলেও চা বাগান এলাকা থেকে বহুদূরের উচ্চ বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠাবার সাহস করেন না অনেকেই।
জীবনের দুষ্টচক্র : চা গাছ রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা আর চা পাতা সংগ্রহের প্রধান কাজটি নারী শ্রমিকেরা করে আসছে বংশানুক্রমে। নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় অনেক যতেœর সাথে এই কাজ করে। পুরুষ শ্রমিকদের একটি বড় অংশই কাজ করে চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করার কারখানায়, নিরাপত্তাকর্মী, চা পাতা পরিবহন, ওজনকারী, বাগানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কিংবা শ্রমিকদলের সর্দার হিসেবে। কিন্তু চা শ্রমিকদের এই বিশাল অংশের কি চা বাগানে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ নেই?
মালিক কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করে আবাসনের : এই স্বল্প মজুরীতে যেখানে তাদের জীবন ধারণই কঠিন সেখানে তাদের কেউ টাকা সঞ্চয় করে জমি কিনে মূলধারার সমাজে বসবাস শুরু করবে এই চিন্তাটিও করা কঠিন। ভাষা আর সংস্কৃতির বিস্তর ফারাকের কারণে মূলধারার বাঙালি সমাজের কাছেও নিগ্রহের শিকার এই চা শ্রমিকেরা। চা বাগানের শিশুরাও প্রাক প্রাথমিক আর প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পেরোতে পেরোতেই ডাক পড়ে চা বাগানে কাজ করার। পরিবারের বয়স্ক সদস্যের কেউ চা শ্রমিকের পদ থেকে অবসর নিলে সেই পরিবারের কাউকে চা শ্রমিক হিসেবে নিবন্ধনের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যাতে তার পরিবারের আবাসনটি টিকিয়ে রাখা যায়। এভাবে যুগের পর যুগ ধরে চা বাগানের ভেতরেই জীবন বাঁধা পড়ে আছে তাদের। চা বাগানের শ্রমিকেরা বংশানুক্রমে শত শত বছর ধরে চা বাগানের ভেতরের জমিতে বসবাস করেও পায় না জমির মালিকানা, এক টুকরো জমির জন্য এরা জিম্মি হয়ে আছে মালিকশ্রেণির কাছে। তবে এর মধ্যেও খুব অল্পসংখ্যক লোক চা বাগান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা গ্রহণ করে মূলধারার সমাজে মিশতে শুরু করেছেন।
চা বাগানে অল্প করে হলেও শিক্ষার আলো পৌঁছাতে শুরু করেছে, চা বাগানের শ্রমিকেরা নিজেরাই এখন বিশ্বাস করে শিক্ষাই হতে পারে ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার। তবে প্রান্তিক এই জনপগোষ্ঠীর দরকার একটু সহানুভুতি, ভালোবাসা আর মানুষ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর অধিকার।