শিবরাত্রির ব্রতকথা
আজ শিবরাত্রি। ফাল্গুন মাসে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে দেবাদিদেব মহাদেবের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মহাদেব একইসাথে শিব, ভোলানাথ, শম্ভু, রুদ্র প্রভৃতি নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত। পরমেশ্বর ভগবান ছয় ধরনের অবতারের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে কার্য সম্পাদন করেন। একটি ধরণ হচ্ছে গুনাবতার। প্রকৃতির তিন গুন- সত্ত¡, রজঃ, তমঃ। এর অধীশ্বর দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব যথাক্রমে সৃষ্টি, পালন ও প্রলয়ে নিয়োজিত। ঈশ্বরই জাগতিক প্রয়োজন মহাপ্রলয় সাধনে মহাদেব রূপে আবিভর্‚ত হন। ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৪৫) বলা হয়েছে-
‘ক্ষীরং যথা দধি বিকার বিশেষ যোগ্যাৎ সঞ্জায়তে
ন হি ততঃ পৃথগস্তিহেতোঃ।
য সম্ভবতা মপি তথা সমুপৈতি কার্যাদ
গোবিন্দমাদি পুরুষং তমহং ভজামি।’
দুধকে যেমন টক দিয়ে দইয়ে পরিণত করা হলেও তার গুণ পরিবর্তন হয় না। তেমনই যিনি কার্যবশত শম্ভুতা প্রাপ্ত হন সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি। ভগবানের এই রূপরেও তাৎপর্য আছে। কারণ প্রেম-ভালবাসা দিয়ে ধ্বংস বা বিনাশ কার্য সম্পাদন মানানসই হয় না। মহাদেব পৃথক কোন ব্যক্তি নয় বা পরমেশ্বর ভগবানের দ্বিভুজ মুরলীধর রূপও নয়। জীবকে শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনিই আবার সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবদ্ভক্ত ‘বৈষ্ণবানাং যথাশম্ভু’ (ভাগবত ১২/১৩/১৬)।
‘শিব’ শব্দের অপর একটি অর্থ হল- মহাপ্রলয়ের পর যার মধ্যে অনন্ত মহাবিশ্ব নিদ্রিত অবস্থায় থাকে। ‘লিঙ্গ’ শব্দটির অর্থও একই, যেখানে বিশ্বব্রহ্মাÐ ধ্বংসের পর সকল সৃষ্টবস্তু বিলীন হয়ে যায়। অথর্ব বেদের সংহিতা গ্রন্থে যুপস্তম্ভ নামে একপ্রকার স্তোত্রে শিবলিঙ্গকে আদি ও অন্তহীন এক স্তম্ভ বা স্কম্ভরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এই স্তম্ভটি চিরন্তন ব্রহ্মের স্থলে স্থাপিত। যজ্ঞে বৈদিক ঋষিদের যুপস্তম্ভ স্তোত্র পাঠে ঘৃত প্রভৃতি অর্ঘ আহুতি দানের ফলে যজ্ঞপুরুষ প্রসন্ন হলে সেখানে যজ্ঞের অগ্নি, ধোয়া, ভষ্ম, সোমলতা, ও যজ্ঞের কাষ্ঠবাহী ষাড়ের ধারণা থেকে প্রতীয়মান শিবের উজ্জলদেহ, তাঁর কর্পূরকুন্দ ধ্বল জটাযুক্ত চুল, নীলকন্ঠ ও তাঁর বাহন বৃষ এর ধারণাটিই স্পষ্ট হয়ে উঠে। কালক্রমে এই যুপস্তম্ভই শিবলিঙ্গের রূপ ধারণ করেছে। লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থে এই স্তোত্রটিই উপাখ্যানের আকারে বিবৃত হয়েছে। আর এই উপাখ্যানেও কীর্তণ করা হয়েছে সেই মহাস্তম্ভ ও মহাদেবরূপী শিবের মাহাত্ম। আর এর থেকেই মহাদেবের পূজার প্রচলন শিবলিঙ্গেই বেশী ভক্তিভাব পরিলক্ষিত হয়।
শিবের অপর নাম ত্রিপুরান্তক। শাস্ত্রকারগণ এই নামের ব্যাখ্যা অতীব তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। মানবদেহ তিন প্রকার- স্থূলশরীর বা বহিঃদেহ, সূক্ষশরীর বা মন এবং কারণ শরীর বা আত্মার চৈতত্যময় রূপ। এই তিন শরীরকে একত্রে ত্রিপুর বলা হয়েছে। ত্রিপুরান্তক বেশে মানব সত্ত¡ার এই ত্রিমুখী অস্তিত্বের ধ্বংস ও বিলোপ ঘটিয়ে মানবকে পরম সত্ত¡ার সাথে লীন হতে তিনি সহায়তা করেন।
শিবের প্রণাম মন্ত্রঃ (ওঁ) মহাদেবং মহাত্মনং মহাযোগিনমীশ্বরম্। মহাপাপহরং দেবং মকরায় নমোনমঃ।। (ওঁ) নমস্তভ্যং বিরূপাক্ষ নমস্তে দিবচক্ষুষে। নমঃ পিনাক হস্তায় বজ্রহস্তায় বৈ নমঃ। নমঃত্রিশূলহস্তায় দন্ডপাশাংসিপানয়ে নমঃত্রৈলোক্যনাথায় ভূতানাং পতয়ে নমঃ। (ওঁ) বাণেশ্বরায় নরকার্ণবতারায় জ্ঞানপ্রদায় করুণাময়সাগরায়। কর্পুরকুন্দ ধবলেন্দু জটাধরায়।দারিদ্র-দুঃখদহনায় নমঃ শিবায়।। নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বংগতি পরমেশ্বর।।
শিবের প্রণাম মন্ত্র থেকে পাই, শিবরাত্রি ব্রতকরলে বহু জন্মের মহাপাপ দূরীভুত হয়, তিনি জ্ঞান প্র্রদান করেন, দারিদ্র ও দুঃখ দহন করেন এবং সর্বরোগের বিনাশ সাধন করেন।তিনি মায়া ও অজ্ঞানতাকে ধ্বংস করে পরম চৈতন্যর সঙ্গে ভক্তের মিলন ঘটান।
লেখক : ভক্তিশাস্ত্রী, মায়াপুর ইনস্টিটিউট অব হায়ারস্টাডি, ইসকন, ঢাকা।