প্রয়োজন নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
বিভুরঞ্জন সরকার : ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ৮ মার্চ এক অনির্বাণ শিখার মতো আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করছে।
স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছরে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা ও অবস্থানের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নকে সংকুচিত করতে চাইলেও নারীরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই ধারাবাহিকভাবে লড়াই-সংগ্রাম করছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা ভালো কিছু অর্জনও করছেন। আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় প্রয়োজনের তাগিদেই নারী শিক্ষা গ্রহণে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং প্রশাসনসহ বিভিন্ন পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। তারপরও একথা ঠিক যে, আজও পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে নারীদের নির্যাতন-হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নারীর স্বাভাবিক মর্যাদাকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু নারীরা পরিবর্তনের জন্য যতোটা লড়ছেন, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত ততোটা নারীবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি। নারীর পক্ষে যেসব আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নির্যাতনের শিকার নারীর প্রতি পুলিশ কিংবা সরকারি প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি যতোক্ষণ পর্যন্ত ইতিবাচক না হবে ততোক্ষণ পর্যন্ত শুধু আইন করেই সুফল পাওয়া যাবে না। সে জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা, কষ্ট, যন্ত্রণা ও ক্ষতি যথাযথভাবে পরিমাপ করা কখনই সম্ভব নয়। নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির দিক অনেক। নির্যাতনের প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে- শারীরিক ও মানসিক আঘাতজনিত চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্য হানির ক্ষতি, কর্মক্ষেত্রে যেতে না পারার ক্ষতি, আইন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত খরচ, বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যয়, সন্তানের জন্য ব্যয়ভার ইত্যাদি। পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়েও অনেক বেশি। ২০১১ সালের আগস্ট মাসের এক গবেষণা থেকে জানা যায় বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের কারণে বছরে ব্যয় ১৪ হাজার কোটি টাকার উপরে, যা মোট জিডিপির ২ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং এই ব্যয় দেশের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিখাতে সরকারি ব্যয়ের প্রায় সমান। নারী নির্যাতনের ফলে শুধু ব্যক্তি বা পরিবার নয় সরকারও বড় রকমের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এছাড়া নারী নির্যাতনের ফলে নারী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এমন সব ক্ষতির শিকার হয় যা টাকার অংকে হিসাব করা আদৌ সম্ভব নয়।
জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থেই নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে সবারই আন্তরিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করা দরকার। দেখা যাচ্ছে, নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমাদের দেশে নারীরা নিজের জীবনে, পরিবারে, সমাজে এবং জাতীয়ভাবে নিয়ে এসেছে ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন। বাংলাদেশের নারীরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত চূড়ায় ওঠার সাফল্য দেখানোর পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রশাসন, রাজনীতি সবক্ষেত্রেই রাখছেন মূল্যবান অবদান। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ অধিকতর নারীবান্ধব হলে নারীরা যেমন আরো সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে তেমনি দেশকেও সামনে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক : নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ, সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সকল নাগরিককে আইনের দৃষ্টিতে সমান বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যেÑ ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জš§স্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ সংবিধান সমাজ ও জনজীবনে নারী-পুরুষ সমতা ও বৈষম্য রোধের উপর জোর দিলেও ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক জীবনে নারীর অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো কথা বলেনি। ফলে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন সমস্যা ও বিরোধের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনুসৃত ধর্মীয় বিধান অনুসারে প্রণীত পারিবারিক আইনসমূহের আশ্রয় নেয়া হয়। এ কারণে একই ধরনের ঘটনা বা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের নারীদের মধ্যে বৈষম্য দেখা দেয়। আবার একই ধর্মের নারী-পুরুষের মধ্যেও বৈষম্য হয়ে থাকে, কেননা এসব ধর্মীয় আইনের অনেককিছু দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার ও যুগোপযোগী না করায় এতে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক অনেক বিষয় রয়ে গেছে। এভাবে সংবিধান জাতীয় জীবনে সমতার গ্যারান্টি দিলেও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে জাতিসংঘ ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদের ধারা ২ এবং ১৬.১.গ-এর উপর আরোপিত সংরক্ষণ এখনো অব্যাহত আছে, যা সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। ধারাগুলো সংরক্ষণের ফলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে বিশেষ করে বিয়ে এবং বিয়ে বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী প্রবল বৈষম্যের শিকার হয়। বলা হয়ে থাকে যে সংরক্ষিত ধারাগুলো মুসলিম শরিয়া আইন পরিপন্থী, কিন্তু ঠিক কোথায় কোথায় এই দ্বন্দ্ব বা বৈপরীত্য তা কিন্তু স্পষ্ট করে বলা হয় না।
যুগ যুগ ধরে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার এদেশের বৃহত্তর নারী সমাজের ভাগ্যোন্নয়ন তথা নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশনের আলোকে প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি নিয়েও কম জল ঘোলা করার চেষ্টা করেনি একটি মহল। ১৯৯৭ সালে প্রণীত নারী নীতিটি সংশোধনের নামে এর মূল চেতনাটিই হারিয়ে যেতে বসেছিলো ২০০৪ সালে। নারী ও মানবাধিকার সংস্থাসমূহের দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০১১ সালে সংশোধিত নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করা হলে নারী স্বার্থবিরোধী একটি উগ্রগোষ্ঠী এটিকে কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী বলে অপপ্রচার চালিয়ে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ছেলে ও মেয়ের সম্পত্তির সমানাধিকার নিয়ে নারী আন্দোলনকারীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সেই দাবির প্রতিফলন নারী নীতিতে না থাকলেও, উগ্রপন্থীরা এ নিয়ে অপপ্রচার চালিয়েছে এবং নারী নীতি বাতিলের দাবি তুলেছে। এক পর্যায়ে সরকারও বলেছে যে নারী নীতিতে কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনোকিছু তারা রাখবেন না। এভাবে ধর্মের নামে নারীকে অধিকারবঞ্চি করে রাখার অপপ্রয়াস বিভিন্ন সময়ে নানা মহল থেকে চালানো হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না আনার অজুহাতে অন্যরা তাতে পরোক্ষ মদদ যুগিয়েছে।
নারী আজ জাতীয় উন্নয়নের সমান অংশীদার। তাই নারীর অগ্রগতির পথে যেসব সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রতিবন্ধকতার ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো মোকাবেলা করে আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নারী-পুরুষ সবাইকে একযোগেই কাজ করতে হবে।
লেখক : গ্রুপ যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়