প্রযুক্তিখাতে নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ
আবুল বাশার
মানবসভ্যতা প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে। আর সেইসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগোচ্ছে মানুষ। প্রতিনিয়ত আমরা নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম-অধিকার এবং সমবণ্টনের কথা বলছি। বলছি, দুজনের সমান সুযোগ পাওয়ার প্রয়োজনের কথা। অনেক ক্ষেত্রে এই প্রয়োজন অনেকটা মিটেছে। নারী পুরুষের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে নানা পেশায় অংশ নিচ্ছে, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অংশ নিচ্ছে পরিবার ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যাপারেও। তবু কোথাও যেন একটা কিছু গড়মিল থেকে গেছে। কিছু ব্যাপারে এখন অব্দি নিজেকে সমতার পর্যায়ে ঠিক নিয়ে যেতে পারেনি নারী। কিছু ক্ষেত্রে তাকে সেই সুযোগটাও পুরোপুরি দেওয়া হয়নি। তেমনই এক ক্ষেত্র হচ্ছে প্রযুক্তিক্ষেত্র।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির সঙ্গে না থাকা, আর অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর মানুষ হয়ে থাকা একই কথা। নিত্যনতুন নানা প্রযুক্তির উদ্ভাবন করছে মানুষ। আচ্ছা, একটা মিনিট ভাবুন দেখি। কয়জন সফল নারীর নাম মনে করতে পারেন আপনি প্রযুক্তি খাতে? পুরুষের কথা বলতে গেলে একেবারে অজ্ঞ কেউ একজনও স্টিভ জবস বা মার্ক জাকারবার্গের নাম বলে দিতে পারবে। কিন্তু নারী? তাহলে কি এই চাওয়াটা ঠিক ছিল না? শুরু থেকে এসটিইএম, বা সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথমেটিক্সে পিছিয়ে ছিল নারী। সেই অনগ্রসরতা এখনও কাটেনি। এই না পারাটা কি তাহলে নারীরই অক্ষমতা?
প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরুষেরা যদি প্রযুক্তি খাতের ৮০ শতাংশ জুড়ে থাকে, তাহলে নারীরা আছে বাকি ২০ শতাংশে। কখনও এই অংশটুকুও কমে আসে তাদের জন্য। বর্তমানে প্রযুক্তি খাতের বাঘা বাঘা সব কোম্পানি গুগল, ফেসবুক বা অ্যাপল আগের চেয়ে প্রায় ২৩৮ শতাংশ বেশি নারীকর্মীকে প্রাধান্য দিচ্ছে চাকরির ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের অবস্থান থেকে খুব বেশি স্পষ্ট দেখা না গেলেও পৃথিবীজুড়ে প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ২০১৫ সালের এক তথ্যানুসারে, ফেসবুকে বর্তমানে আগের চেয়ে ৮৪ শতাংশ বেশি নারীকর্মী আছেন।
করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি থেকেও অনেক প্রতিষ্ঠান নারীদের নিয়োগ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের জন্য নারীদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন নিয়োগকর্তারা। তবুও বর্তমানে প্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কাজগুলোতে মাত্র ২৫ শতাংশ নারী কাজ করছেন। তাদের মধ্যেও অনেকেই চলে যাচ্ছেন নিজেদের অবস্থান থেকে। এই পুরো অংশটির ৫৬ শতাংশ চলে যাচ্ছেন প্রযুক্তি খাতের বাইরের কোনো চাকরিতে। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ নারীর কর্মক্ষম অবদান ছিল প্রযুক্তি খাতে। বর্তমানে এই সংখ্যা অনেকটা বেড়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তি খাতে পাঁচ শতাংশ নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সাত শতাংশ নারী অংশীদার হিসেবে কাজ করছেন এবং বাকি ৩০ শতাংশ নারী সাধারণ কোনো পদে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে গুগলে নারীকর্মীর সংখ্যা ১৭ শতাংশ, টুইটারে ১০ শতাংশ ও ফেসবুকে ১৫ শতাংশ। এমন নয় যে নারীরা কোনো প্রতিষ্ঠানে অংশ নিলে খারাপ ফল হচ্ছে। তবে তার পরও অংশিদারিত্বে তারা আছেন মাত্র ১৭ শতাংশ স্থানজুড়ে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু মানুষের নাম বলতে গেলে সামনে আসবে ইউটিউবের সিইও সুজান ডায়নে ওজেস্কি, আইবিইএমের সিইও ভার্জিনিয়া ম্যারি গিনি রোম্যাটি, ফেসবুকের সিইও শের্ল স্যান্ডবার্গ, প্ল্যানগ্রিডের সিইও ট্রেসি ইয়াং, গুগলের সিএফও রুথ পোরাট, মাইক্রোসফটের সিএফও অ্যামি হুডের মতো কিছু নারীর কথা। তবে এ তো গেল হাতেগোনা কয়েকজন। বাকিরা? বাকিরা কেউ অনেক আশা নিয়ে প্রযুক্তি খাতে চাকরি করতে আসছে এবং কিছুদিন পর হতাশ হয়ে বিদায় নিচ্ছে। তবে যারা এই খাতে আসতে চাইছে, তাদের সংখ্যাটাও খুব বেশি নয়।
প্রথমত, সমাজ ও পরিবার নারীকে ‘ও তো মেয়ে, পারবে না’ বলে প্রযুক্তির ধারকাছ থেকে সরিয়ে রাখছে। এমনটা হলে বেশিরভাগ নারী ছোটবেলা থেকেই এই সুযোগটা পাচ্ছে না যে তারা অন্যান্য ব্যাপারের মতো শিক্ষার এই পেশাটিকেও ঝালিয়ে দেখবে। মেয়েরা মানবিক বিভাগে ভালো করবে ভেবে যদি আপনি আপনার মেয়েকে মানবিক বিভাগেই পড়ান, তাহলে সে নিশ্চয় প্রযুক্তি খাতে প্রবেশ করবে না? পড়াশোনা শেষ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয় থেকেই, তবুও প্রায় ৪০ শতাংশ নারী এর পরও প্রযুক্তি খাতে প্রবেশ করে না। মানসিক এই বাধাই নারীর জন্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি খাতে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো যে কারণেই হোক না কেন, নারীদের চাকরি দিচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। নারীদের চাকরি আগের চেয়ে বেশি প্রদান করলেও প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানে নারীদের চেয়ে পুরুষকর্মী নেওয়ার প্রবণতা থাকে বেশি। এখনও যতটা নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তার চেয়ে শতকরা দুই ভাগ বেশিবার পুরুষদের নিয়োগ দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। নারীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় চুপ থাকার প্রবণতা কাজ করে।
তৃতীয়ত, নারীরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখনও ততটা পায়নি যতটা তাদের পাওয়া প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে এখনও আদিম এই সমস্যাগুলো কাজ করে চলেছে। তবে সেজন্য যেমন তার চারপাশের সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন নিজেকে নিজেরও সহযোগিতা করা। প্রযুক্তি খাতে নারীর অবদান সবসময় ছিল। তবে সেটাকে উল্লেখ করা হয়েছে গৌণভাবে। মধ্যযুগ কিংবা বর্তমান সময়ে। প্রযুক্তিতে নারীর অবদান অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। তাই সময় এসেছে ব্যাপারটিকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে দেখার ও নেওয়ার। নারী কিংবা পুরুষ নয়, মানুষ হিসেবে প্রযুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় এখন নারীদেরই শুধু।