‘নিষিদ্ধ’ পপকর্ন যেভাবে সিনেমা হলের অংশ হলো
আবুল বাশার
সিনেমাহলে সিনেমা দেখার সময় বা মধ্যবিরতিতে প্রায় সব দর্শককেই পপকর্ণ খেতে দেখা যায়। এটি এখন একটি নিয়মিত দৃশ্য। কিন্তু আজ থেকে একশ বছর আগে এমন ছিল না। তখন সিনেমা থিয়েটারে পপকর্ণ নিয়ে খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। শুধু পপকর্ণই নয়, কোনো খাবারই নেয়া যেত না সিনেমা দেখার সময়। সেই নিষিদ্ধ পপকর্ণ কীভাবে সিনেমা হলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল আর কেনই বা নিষিদ্ধ ছিল তা নিয়েই আজকের এই আয়োজন। পপকর্ণের ইতিহাস নতুন নয়। প্রায় ৮,০০০ বছর আগে ভুট্টা চাষ করা হতো টিওসিন্টে থেকে। এন্ড্রু স্মিথের ‘পপড কালচার: অ্যা সোশাল হিস্ট্রি অব পপকর্ণ’ বইয়ে পপকর্ণের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। তার ভাষায়,
উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে উত্তর আমেরিকার তিমি শিকারীরা চিলিতে যায়। সেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের পপকর্ণের সাথে পরিচিত হয়। তারা এগুলো পছন্দ করে। তাই সেখান থেকে তারা পপকর্ণ নিউ ইংল্যান্ডে নিয়ে আসে। সেই সময় থেকে পপকর্ণ আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিনোদনের ক্ষেত্রে পপকর্ণ হয়ে ওঠে খাবারের অন্যতম একটি মেন্যু। এজন্য তখন প্রায় সকল বিনোদন কেন্দ্রেই পপকর্ণের উপস্থিতি দেখা যায়। পপকর্ণের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হলো এটি যেকোনো স্থানে তৈরি করা যেত। ১৮৮৫ সালে চার্লস ক্রেটর বাষ্পচালিত পপকর্ণ তৈরির যন্ত্র আবিষ্কার করেন। ফলে এই যন্ত্র দিয়ে রাস্তাঘাটে যেকোনো স্থানে পপকর্ণ তৈরি করে দ্রæত বিক্রি করা সম্ভব হয়। এতে রাস্তায় বা মাঠে-ময়দানে পপকর্ণ বিক্রি অনেক বেড়ে যায়।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আমেরিকানদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে নির্বাক সিনেমা। থিয়েটারে নির্বাক সিনেমা দেখার জন্য দর্শকদের ভিড় থাকতো প্রচুর। তবে থিয়েটার মালিকরা সে সুযোগ রেখেছিলেন শুধুমাত্র সমাজের অভিজাত শ্রেণীর জন্য। তখন শিক্ষিত লোকদের জন্যই মূলত থিয়েটারে সিনেমা প্রদর্শিত হতো। সিনেমা হলের মেঝেতে থাকতো আকর্ষণীয় লাল কার্পেট। দর্শকদের বসার জন্য বিশেষ কম্বলও থাকতো। পপকর্ণ আনার সুযোগ দিলে দর্শকরা সেগুলো নোংরা করে ফেলতে পারেন। তাই থিয়েটার মালিকরা পপকর্ণ নিষিদ্ধ রাখেন। এ সময় শুরু হয় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দা। এটি পুরো ত্রিশের দশক জুড়ে থাকে, যা ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামে পরিচিত। তবে অন্যান্য ব্যবসা এই মহামন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সিনেমা ও পপকর্ণের জন্য এটি ছিল একটি বিশাল সুযোগ। তখন বিনোদনের সস্তা মাধ্যম সিনেমা হওয়ায় দর্শকরা এখানে ভিড় করে। তখন প্রতি ব্যাগ পপকর্ণের দাম ছিল পাঁচ থেকে দশ সেন্টের মধ্যে, যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল। পাইকারী হারে সরবরাহকারীদের জন্যও ছিল এটি একটি লাভজনক বিনিয়োগ। থিয়েটারের লোকরা এতে উদাসীন থাকলেও অন্যরা ঠিকই এই সুযোগটি গ্রহণ করলো।
থিয়েটার মালিকরা তখন পপকর্ণ বিক্রেতাদের থিয়েটারের লবিতে পপকর্ণ বিক্রির অনুমতি দেন। এতে বিক্রেতাদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফী নেয়া হয়। বিক্রেতাদের তাতে কোনো আপত্তি ছিল না। কারণ এই সুবিধায় তাদের বিক্রি আরো বেড়ে যায়। একইসাথে সিনেমা দেখতে আগত দর্শক ও রাস্তার পথচারী সকলের কাছেই তাদের পপকর্ণ বিক্রি হতে থাকে। থিয়েটার মালিকরা তখন বুঝতে পারেন, তারা যদি নিজেরাই পপকর্ণ বিক্রি শুরু করেন সেটা আরো লাভজনক হবে তাদের জন্য। এমনই ভাবনা আসে এক থিয়েটার ম্যানেজারের মনে। তিনি হচ্ছেন আর জে ম্যাককিনা। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে কিছু সিনেমা থিয়েটার পরিচালনা করতেন। ম্যাককিনার একটি থিয়েটারের বাইরে এক বৃদ্ধ লোক পপকর্ণ বিক্রি করতো। ঐ লোক পপকর্ণ বিক্রি করে এতই লাভবান হয় যে সে একটি বাড়ি, একটি ফার্ম ও একটি দোকান কিনে ফেলে। তখন ম্যাককিনা একটি পপকর্ন মেশিন নিয়ে আসেন তার থিয়েটারে। এতে ১৯৩৮ সালে পপকর্ণ থেকেই তার আয় হয় দুই লাখ ডলার। তখন থেকেই থিয়েটারগুলোতে শুরু হয় পপকর্ণের ব্যবসা।
পপকর্ণের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। পপকর্ণের প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল চকলেট ও কোমল পানীয়। এসব পণ্যের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল হলো চিনি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে আমেরিকায় চিনি আমদানি বন্ধ থাকে। তাই চকলেট ও পানীয় উৎপাদন কমে যায়। আর এই সুযোগে পপকর্ণ আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ১৯৪৫ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধেকেরও বেশি পপকর্ণ বিক্রি হয় সিনেমা থিয়েটারে। আধুনিক সিনেমা হলগুলোতেও লভ্যাংশের একটি বড় অংশ আসে পপকর্ণ থেকে। সিনেমা থিয়েটারগুলোতে গত কয়েক বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা, অ্যালকোহল ও অন্যান্য খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও পপকর্ণ এখনও তার আবেদন ধরে রেখেছে।