আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ৫
বিইআরসি’র চেয়ারম্যান জানালেন ১০২ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পাবে না দাম বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কারণ দেখাচ্ছে না পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কর্তৃপক্ষএলএনজি আমদানির অজুহাতে কর্ণফুলির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব
স্বপ্না চক্রবর্তী : গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে কোম্পানিগুলোর করা আবেদনের প্রেক্ষিতে ৪ দিনব্যাপী গণশুনানির শেষ দিনে নিজেদের প্রস্তাবনা জানিয়েছে কর্ণফুলি ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। এদের মধ্যে কর্ণফুলি গ্যাস কোম্পানি এলএনজি আমদানির অজুহাতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করলেও দাম বাড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখাতে পারেনি পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। এদিকে গণশুনানীর শুরুর দিন থেকেই বিভিন্ন মহলে তৈরি হয়েছে অসন্তোষ। কেউ কেউ আবার প্রকাশ্য প্রতিবাদেও নেমেছেন। তাদের দাবি, অতিরিক্ত টাকা খরচ করে এলএনজি আমদানি নির্ভরতার চাইতে কূপ খননে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেশের ভেতরেই গ্যাস সন্ধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এর আয়োজনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর গণশুনানীর ৪র্থ দিন কর্ণফুলি ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তাদের প্রস্তাবে আবাসিকে এক চুলার বর্তমান দর ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৩৫০ টাকা, দুই চুলা ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৪০ টাকা এবং প্রি-পেইড মিটারে ৯ দশমিক ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ দশমিক ৪১ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম তিন দশমিক ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৪ টাকা, সিএনজিতে ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ১০ টাকা, সার উৎপাদনে প্রতি ঘনমিটার দুই দশমিক ৭১ টাকা থেকে বাড়িয়ে আট দশমিক ৪৪ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯ দশমিক ৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ দশমিক শূন্য ৪ টাকা, শিল্পে সাত দশমিক ৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪ দশমিক শূন্য পাঁচ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ১৭ দশমিক শূন্য চার টাকার পরিবর্তে ২৪ দশমিক শূন্য পাঁচ টাকা করার প্রস্তাব করে। একই সঙ্গে তারা বিতরণ চার্জ নির্ধারণেরও প্রস্তাব দেয়।
কোম্পানিগুলোর এই দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বিইআরসি’র চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো যা চায় আমরা সেই হারে বৃদ্ধি করি না। চাওয়ার তুলনায় অনেক কম বৃদ্ধি করি বলে বিতরণ কোম্পানি অসন্তুষ্ট হয়, আবার দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে গ্রাহক বিষয়টি ভালো চোখে দেখেন না। তিনি কমিশনের কাছে করা ২০০৯ সাল ও এর পরবর্তী আবেদন এবং মূল্যবৃদ্ধির শতকরা হার তুলে ধরে বলেন, ২০০৯ সালে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ৬৫ দশমিক ৯২ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির আবেদনের প্রেক্ষিতে বেড়েছিল ১১ শতাংশ। এখানে পর্যায়ক্রমে ২০১৫ সালে ৪০ দশমিক ৭৯ শতাংশ দাম বৃদ্ধির আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৬ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৯৫ ভাগের বিপরীতে ১১ ভাগ দাম বাড়ে। এরপর ২০১৮ সালে ৭৫ ভাগ দাম বৃদ্ধির আবেদনের প্রেক্ষিতে কোন দাম বাড়েনি। এবার বিতরণ কোম্পানিগুলো সংশোধিত প্রস্তাবে ১০২ শতাংশ দাম বৃদ্ধির আবেদন করেছে। তবে এতোটা দাম বৃদ্ধি পাবে না এমন পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি। আইনের মধ্যে থেকে যৌক্তিক এবং নিরপেক্ষ দাম নির্ধারণ করবে কমিশন। গ্রাহকের অর্থে গ্যাস এবং বিদ্যুত উন্নয়ন তহবিল করা হয়েছে, গড়ে তোলা হয়েছে জ¦ালানি নিরাপত্তা তহবিল।
এসব তহবিলের সঠিক ব্যবহারের উপর জোর দিয়ে মনোয়ার ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা, পিডিবিকে বলেছি এই তহবিল সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। এতে করে দেশের জ¦ালানি এবং বিদ্যুতে স্বনির্ভর হবে।
এসময় পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) হারুন উর রশীদ বলেন, ৫০০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করায় ৯ মাসে ৯ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। আমরা মুনাফা করতে চাই না, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে চাই, আপনারাও চান। সেই কারণে আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানি করতে হলে দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। দেশীয় তেল-গ্যাস আহরণে সেভাবে কাজ না হওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, দক্ষ লোকবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সাগরে তেল-গ্যাস আহরণে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই। আমরা চাচ্ছি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে। কিন্তু মডেল পিএসসির দাম আকর্ষণীয় নয়। সে কারণে সংশোধনীতে দাম আকর্ষণীয় করা হচ্ছে।
দুর্নীতির কারণে জ্বালানির দাম বাড়ে, ভোক্তাদের এই অভিযোগের বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের যুগ্মসচিব জহির রায়হান বলেন, একদিনে বিপ্লব করতে পারবো না। একটু একটু করে এগিয়ে যেতে পারলে ভালো। সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর ভূইয়া বলেন, ৩২ টাকা থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৮ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর প্রভাব কী হতে পারে কেউ ভাবছেন না। এই ঢাকায় এক সময় কালো ধোঁয়ায় থাকা যেতো না। সেই কারণে সিএনজি জ¦ালানিতে যাওয়া হয়। এখন বলা হচ্ছে তেলের দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। ভবিষ্যতে ঢাকার পরিণতির কথা ভাবতে হবে। দাম বেড়ে গেলে গাড়ি ভাড়া বেড়ে যাবে। এতে অরাজকতা দেখা দিতে পারে। দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার।
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চলের পক্ষ থেকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানায়, বর্তমান প্রস্তাবনা অনুযায়ি গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৮৭ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৪৮ দশমিক ৩০ মিলিয়ন টাকা অতিরিক্ত উৎসে আয়কর কাটা হবে। এজন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব চাহিদা হবে যথাক্রমে এক হাজার ১৮১ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন টাকা এবং এক হাজার ৩৫৩ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন টাকা। এরই প্রেক্ষিতে যৌক্তিকভাবে ভারিত গড়ে প্রতি ঘনমিটারে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ দশমিক ৬৪ টাকা এবং ১ জুন থেকে শূন্য দশমিক ৯৭৩ টাকা বিতরণ চার্জ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়েজ আহমদ মজুমদার বলেন, কোম্পানির পক্ষ থেকে এলএনজি আমদানির কারণে গ্রাহক পর্যায়ে ৪০ দশমিক ২৫ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ২১১ ভাগ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। একইসাথে বিতরণ চার্জ শূন্য দশমিক ২৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ১ দশমিক ০৬ টাকা এবং শুন্য ৭৭ টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
এদিকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ও কর্ণফুলি গ্যাস কোম্পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিষয়ে মূল্যায়ন কমিটির পক্ষ থেকে মো. কামরুজ্জামান জানান, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিদিন গড়ে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি বিবেচনায় গ্যাসের গড় সরবরাহ ব্যয় দাঁড়ায় প্রতি ঘনমিটার ৭ টাকা ৯২ পয়সা। অন্যদিকে প্রতিদিন গড়ে ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ বিবেচনায় গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় দাঁড়ায় প্রতি ঘনমিটারে ১১ টাকা ৭৭ পয়সা। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিদিন গড়ে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ বিবেচনায় গ্যাসের গড় সরবরাহ ব্যয় প্রতি ঘনমিটারে ১২ টাকা ৪৩ পয়সা হবে। তিনি বলেন, কমিশন গত বছরের ১৬ অক্টোবর জারি করা আদেশে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির বিতরণ চার্জ শূন্য দশমিক ৩৩৯৪ টাকা এবং কর্ণফুলির শূন্য দশমিক ২৫ টাকা নির্ধারণ করে। যা গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে কাযকর। ফলে চলতি অর্থবছর শেষে প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে বিতরণ চার্জ পুনর্নির্ধারণ করা যেতে পারে। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান