বিজ্ঞানে অসম্ভব কথাটা আসলে আপেক্ষিক
আবুল বাশার
এমন কোনো একদিন কি আসবে যেখানে দেয়াল ভেদ করে হাটা যাবে অনায়াসে? এমন কোনো নভোযান কি বানানো যাবে যেটি চলবে আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিতে? সম্ভব হবে কি অন্যের মনের কথা পড়ে ফেলা? হওয়া যাবে কি অদৃশ্য? না ধরে না ছুঁয়ে শুধু মনের শক্তি দিয়ে নাড়ানো যাবে কি কোনো বস্তু? পৃথিবীতে বসে দেহকে প্রতিলিপি করে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে কি মহাবিশ্বের দূরবর্তী কোনো গ্রহে? সবগুলো বিষয়ই বর্তমান কালের বিজ্ঞানীদের চোখে অসম্ভব। আর এই অসম্ভবের বিজ্ঞান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন মার্কিন পদার্থবিদ মিশিও কাকু। তিনি জানাচ্ছেন বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অসম্ভব কথাটা আপেক্ষিক। আজকে একটা জিনিস অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে বলে তার মানে এই না যে চিরকালের জন্য অসম্ভব। শত বছর পরে হোক, হাজার বছর পরে হোক, লক্ষ বছর পরে হোক কোনো না কোনোদিন এর বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এই বিষয় নিয়ে তিনি বলেছেন তার বিশ্ববিখ্যাত বই দ্য ফিজিক্স অব দ্য ইম্পসিবল-এ। সেখান থেকে পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি বাংলায়।
একজন পদার্থবিদ হিসেবে আমি অন্তত এটা জেনেছি যে ‘অসম্ভব’ শব্দটি আপেক্ষিক। আমার মনে আছে একদিন আমার শিক্ষিকা দেয়ালে টানানো পৃথিবীর মানচিত্রে আঙুল তোলে আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশকে দেখাচ্ছিলেন। তিনি বলেছিলেন আমেরিকা ও আফ্রিকার সমুদ্র তীরবর্তী অংশটি কেমন অদ্ভুত না? দুই মহাদেশের দুই পাশ কেমন যেন খাপে খাপে মিলে যায়। অনেকটা জিগস পাজলের মতো। বিজ্ঞানীরা ডায়নোসর নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করলেন। আমাদের শিক্ষকরা জানলেন অতীতে ডায়নোসরদের আলাদা এক প্রাণবৈচিত্র ছিল। তারা পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল কয়েক মিলিয়ন বছর। এরপর একসময় তাদের সকলে বিলুপ্ত হয়ে গেল। কেউ জানে না তাদের বিলুপ্তির পেছনে থাকা মূল কারণ। কয়েকজন জীবাশ্মবিদ ভাবলেন মহাকাশ থেকে আসা কোনো এক গ্রহাণুর আঘাতে তারা মারা গিয়েছে। কিন্তু এমনটা তো অসম্ভব। একটা বস্তু এসে পৃথিবীতে পড়বে আর তাতে সকল ডায়নোসর বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমনটা তো সায়েন্স ফিকশনকেও হার মানায় যেন। আজকের যুগের পদার্থবিদদের কাছে এ রকম আশা সাধারণত অসম্ভব বলে বিবেচিত হবে। তো কয়েক শত বছর পর কি এগুলো সম্ভব হতে পারে? কিংবা কয়েক হাজার বছর পর যখন প্রযুক্তি হবে অনেক উন্নত? কিংবা কয়েক মিলিয়ন বছর পর যখন প্রযুক্তির উৎকর্ষ হবে কল্পনাতীত? ব্যাপারটিকে অন্য দিক থেকেও দেখতে পারি, আমরা যদি কোনোভাবে এমন কোনো মহাজাগতিক সভ্যতার দেখা পাই যারা প্রযুক্তির দিক থেকে আমাদের চেয়ে কয়েক মিলিয়ন বছর এগিয়ে আছে তাহলে তাদের ব্যবহার করা প্রযুক্তি কি আমাদের কাছে ‘জাদুময়’ বলে মনে হবে? এই বিষয়টিই এখানের মূল প্রশ্ন, আজকের দিনে কোনোকিছু ‘অসম্ভব’ তার মানে কি এই যে সেটি কয়েক হাজার বছর কিংবা কয়েক মিলিয়ন বছর পরও অসম্ভব থেকে যাবে?
গত শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে কোয়ান্টাম তত্ত¡ এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্তে¡র বিকাশ তার মাঝে উল্লেখযোগ্য। এসব তত্তে¡র সাহায্য নিয়ে কিছুটা অনুমান করা যায় যে অসম্ভবের বিজ্ঞানগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা, কিংবা সম্ভব হলে কখন হবে। এই শতাব্দীতে আরো উন্নত কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত¡ বিকশিত হয়েছে।
আজকে যাকে অসম্ভব মনে হচ্ছে শত বছর পর সেটিই হতে পারে স্বাভাবিক বাস্তবতা। একসময় বিজ্ঞানীরা এগুলোকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিলেও বিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে তারা এগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবছেন। এক-দেড়শো বছর আগে ফিরে দেখি, সে সময়ের প্রেক্ষিতে এমন অনেক প্রযুক্তি ছিল যেগুলোকে সে সময়ের বিজ্ঞানীরা অসম্ভব বলে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের যুগে সেই অসম্ভব জিনিসগুলোই হয়ে উঠেছে আমাদের নিত্য দিনের ব্যবহারের জিনিস। উনিশ শতকের অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর অবস্থান ছিল নেতিবাচক। তাদের অনেকেই এমন কিছু প্রযুক্তিকে অসম্ভব ও দুরাশা বলে রায় দিয়েছিলেন যেগুলো পরে সম্ভব হয়েছিল, সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
ভিক্টোরিয়ান যুগের অভিজাত এক বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন। তিনি বলেছিলেন বাতাসের চেয়ে ভারী এমন কোনো যন্ত্রের পক্ষেই উড়ে চলা সম্ভব নয়। সে হিসেবে উড়োজাহাজ কিংবা হ্যালিকপ্টারের অস্তিত্ব অসম্ভব। তিনি ভেবেছিলেন এক্স-রেও অসম্ভব। এক্স-রে নিয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে তার সবই গুজব। তিনি আরো বলেছিলেন রেডিও প্রযুক্তির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেছিলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। সেই তিনিই নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এর বাস্তবতাকে তুলনা করেছিলেন মাতালের প্রলাপের সাথে।