নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলা বাংলাদেশিসহ নিহত ৪৯
আসিফুজ্জামান পৃথিল, সান্দ্রা নন্দিনী : নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরের দুই মসজিদে সন্ত্রাসীর গুলিতে কমপক্ষে ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩ জন বাংলাদেশি। এই হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে নিউজিল্যান্ডে সফররত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কয়েকজন খেলোয়াড়। তারা জুম্মার নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। নিউজিল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামলায় আহত ৪৮ জন ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই হামলায় প্রধান জড়িত এবং তার চার সঙ্গীকে আটক করেছে পুলিশ। আটক ব্যক্তির নাম ব্রেনটন ট্যারান্ট বলে নিশ্চিত করেছে ডেইলি মেইল। সে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। এই হামলায় নিন্দা জানিয়েছেন বিশ^নেতারা। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ৩ থেকে ৪ জন বাংলাদেশি নাগরিক এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। এই হামলা চালানোর আগে এই উগ্র শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ইন্টারনেটে একটি ৮৭ পৃষ্ঠার ইসতেহার প্রকাশ করে। এই ইশতেহারে তার উগ্র মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। হামলার সময় ট্যারান্ট ফেসবুকের মাধ্যমে লাইভে যায়। ১৬ মিনিট ধরে লাইভ সম্প্রচার করে সে। লাইভে থাকা অবস্থাতেই সে গুলি চালাতে থাকে। এই অভিযুক্ত হামলাকারীকে আজ শনিবার আদালতে হাজির করা হবে বলে জানা গেছে। বিবিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, ডেইলিমেইল, নিউজিল্যান্ড হোরাল্ড, এএফপি।
হামলাকারীর পরিচয় নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, হামলাকারী কট্টর ডানপন্থী। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্কট মরিসন বলেন, ক্রাইস্টচার্চে একজন উগ্র মনোভাবের অধিকারী ডানপন্থী উন্মত্ত জঙ্গি হামলা চালিয়েছেন। হামলাকারী অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়া নাগরিক। তিনি বলেন, নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি তদন্ত করছে। হামলার পরপর হতাহতের খবর নিশ্চিত করেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা অ্যাডর্ন। হামলাকারি ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে হামলা চালায়। একটি ক্রাইস্টচার্চের প্রধান মসজিদ আল-নূর। অপরটি কাছেরই লিনউড জামে মসজিদ। এরমধ্যে ৪০ জন নিহত হয়েছেন আল নূর মসজিদে আর ৯ জন মারা গেছেন লিনউড মসজিদে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী অ্যাডর্ন বলেন, ‘এই হামলা আমাদের দেশের জন্য এক অন্ধকার অধ্যায়। হামলায় এম-১৬ রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে। মূল হামলাকারীসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সন্ত্রাসীরা সুপরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালিয়েছে। আমাদের উপর হামলার কারণ হলো, আমরা বৈচিত্র্যের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং ভিন্ন মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মৌলবাদের কোনো স্থান নিউজিল্যান্ডে নেই।’ পরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডর্ন জানান, হামলাকারী ও তারসাথে গ্রেফতার প্রত্যেকেই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। হামলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলেননি তিনি। হামলার ভিডিও গণমাধ্যমে না প্রকাশ করারও আহ্বান জানান অ্যাডর্ন।
এদিকে, রেডিও নিউজিল্যান্ড তাদের টুইটার অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টে জানায়, ক্রাইস্টচার্চ হাসপাতালে আহত অন্তত ৪৮ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে, হাসপাতালের বাইরে আরেকটি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে দুইটি গাড়ি উদ্ধার করা হয় যার ভেতর একাধিক শক্তিশালী বোমা পাওয়া যায়। নিউজিল্যান্ড পুলিশ কমিশনার মাইক বুশ জানান, ‘দুইটি মসজিদে হামলায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। পাপানুই হাইস্কুলের সামনে থেকে এক নারীসহ সুইসাইড ভেস্ট পরিহিত চারজনকে আমরা গ্রেফতারও করেছি। এদের মধ্যে একজন সামরিক পোশাক পরিহিত ব্যক্তি ছিলো। তবে, তাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িতের কোনও রেকর্ড নেই। আমরা স্থানীয় জনগণকে ওই এলাকা এড়িয়ে চলার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ হামলার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তারা হামলাকারীর আধা-স্বয়ংক্রিয় শটগান থেকে ৫০ রাউন্ডেরও বেশি গুলি চালানোর শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
এই ঘটনায় নিন্দা-শোক জানিয়েছেন বিশে^র বিভিন্ন দেশের নেতারা। শোক জানিয়েছেন ক্যাথলিক চার্চের পোপ ফ্রান্সিস এবং যুক্তরাজ্যের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
একটি টুইট বার্তায় জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিয় গুতারেস বলেছেন, মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। তিনি এই ঘটনার জন্য শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই ঘটনায় শোক জানিয়ে নিজেদের পতাকার পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডের জাতীয় পতাকাও উড়িয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট। দুটি পতাকাই অর্ধনমিত রাখা হয়। এদিকে বন্দুকধারীর তোলা ভিডিও প্রকাশ করায় ক্ষমা চেয়েছেন ব্রিটিশ দৈনিক মিরর এর সম্পাদক লয়েড এম্বলে।
এই হামলার গভীর প্রভাব নিউজিল্যান্ডের উপর পড়বে বলে মনে করেন, দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক। নিউজিল্যান্ড হোরাল্ডকে তিনি জানান, সারাবিশ^ আজ শান্তিপূর্ণ ক্রাইস্টচার্চকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছে। তিনি আশা করেন নিউজিল্যান্ড এবার অস্ত্র আইন কঠোরতর করবে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সকলকে ঘৃণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে নিহতদের প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে নিউজিল্যান্ডের মসজিদগুলো। নিহতদের প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে ওয়েলিংটন, হ্যামিলটন, ডানোডিনসহ বিভিন্ন শহরের মসজিদ প্রাঙ্গরগুলো ভরে উঠে সাদা ফলে। একই ধরণের ঘটনা ঘটেছে লন্ডনেও। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশ মসজিদগুলোকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা গ্রহণ করেছে। জুম্মা উপলক্ষে স্কটল্যান্ডের মসজিদগুলো ঘিরে ফেলে নিরাপত্তা বাহিনী। নিরাপত্তা বর্ধিত করা হয়েছে ফ্রান্সের মসজিদগুলোতেও। নিউ ইয়র্কের মসজিদগুলোতে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। নিউ ইয়র্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট শুক্রবার শহরের মসজিদগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অতিরিক্ত অফিসার প্রেরণ করেছে। টুইটারে তারা লিখেছে, সকল উপাসনালয়ের নিরাপত্তা এবং সকলে যেন নির্ভয়ে ধর্মীয় রীতি পালন করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিউজিল্যান্ড সফর কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিক উৎপল শুভ্র টেলিফোনে জানিয়েছেন, শহরটির রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। ফোনে কথা বলার সময়টি শুক্রবার রাতে হলেও স্বাভাবিক ভীড় ছিলো না রাস্তায়। ক্রাইস্টচার্চ পরিণত হয়েছিলো এক আতঙ্কের নগরীতে। তিনি জানান দলের সঙ্গে তিনিও দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিমানের টিকেট না পাওয়ায় তিনি সোমবারের ফ্লাইটে ফিরবেন। সম্পাদনা : ইকবাল খান