মুদ্রা এলো যেমন করে
কালাম আঝাদ
মানুষের জীবনে মুদ্রা এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সভ্যতার প্রথমার্ধে বিনিময় প্রথা চালু ছিল। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের এমনকি ধাতব মুদ্রার প্রচলন ঘটে। আসতে শুরু করে কাগুজে নোটও। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম- টাকা। টাকা আসলে বিনিময়ের একটা মাধ্যম। ধরো, তোমার একটা আইসক্রিম দরকার, তুমি আইসক্রিম বিক্রেতাকে এর দাম হিসেবে টাকা দিলে। অন্যদিকে আইসক্রিম বিক্রেতার দরকার বাসার জন্য চাল-ডাল। সে আইসক্রিম বিক্রির টাকার একটি অংশ দিয়ে ওই চাল-ডাল কিনবে। মোদ্দাকথা, বিনিময় প্রথায় যেখানে আইসক্রিমের বিপরীতে চাল-ডালওয়ালাকে খুঁজে পেতে ঘর্মাক্ত হতে হতো। এখন আর সেটি করতে হয় না। কারণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে রয়েছে মুদ্রা। এই মুদ্রা ব্যবহার করে যেকোনো কিছুই কেনা যায়। বর্তমানে একেক দেশের মুদ্রার নাম একেক। যেমন কারো নাম রহিম, কারো করিম। কিন্তু দুজনেরই আসল পরিচয় তারা মানুষ। তেমনই টাকা, ডলার, রুপি, দিনার, ইয়েন, রিঙ্গিত, ইউয়ান, ইউরো- সবই হচ্ছে মুদ্রা। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন মুদ্রা ছিল না। তখনও কিন্তু মানুষের বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজন হতো। তাহলে তখন তারা কিভাবে তাদের ওই চাহিদা মেটাত? মুদ্রার প্রচলনের আগে যে পদ্ধতিতে মানুষ তার প্রয়োজনের জিনিস সংগ্রহ করতো, তার নাম বিনিময় প্রথা। ধরো, নদী থেকে করিম মাছ ধরেছে, কিন্তু এতো মাছের দরকার নেই। তার দরকার একটু দুধ। তো সে দুধ বিক্রেতাকে মাছ দিয়ে দুধ নিয়ে নিল। কিন্তু ধরো ওই দুধওয়ালার মাছের দরকার নেই। তাহলে তো করিম মাছ কিনতে পারবে না। অন্যদিকে দুধওয়ালার দরকার একটা তির-ধনুক। কিন্তু তির-ধনুক বিক্রেতার আবার মাছ বা দুধ- এর কোনোটিরই দরকার নেই। তাহলে তো কোনো বিনিময় হবে না। কেউ তার দরকারের জিনিসটা পাবে না। এমন সমস্যার সমাধান করতে মানুষ একটা উপায় খুঁজে বের করল। বিনিময়ের একটি মাধ্যম ঠিক করলো এবং তার একটি মান বেঁধে দিল। সবাই এটা মেনেও নিল। সবাই মেনে না নিলে কিন্তু মুদ্রার কোনো দাম থাকে না। বিনিময়ের ওই মাধ্যম হলো মুদ্রার পূর্বপুরুষ। মুদ্রা বা টাকা আবিষ্কারের আগে বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের বস্তুকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রাচীন ভারতে কড়িকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ফিজি দ্বীপে টাকার কাজ চলতো তিমি মাছের দাঁত দিয়ে। সামোস দ্বীপে মাদুরকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
কোথাও গরু, ছাগল, ভেড়া, কোথাও আবার মাছ ব্যবহৃত হত টাকা হিসেবে। প্রাচীনের কোনো কোনো এলাকায় লবণকে টাকা হিসেবে গণ্য করা হতো। নিউ গিনিতে টাকার কাজ চলত কুঠারে। প্রশান্ত মহাসগরীয় দ্বীপ ইয়াপে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো পাথরের চাকতি। নাইজেরিয়ায় মুদ্রার মর্যাদা পেয়েছিল হাতে পরার বালা। দেশ ভেদে এমন অনেক বিচিত্র জিনিসে মুদ্রার কাজ চলত। কড়ি, মাছের দাঁত, পালক, মাদুর- এসবে লেনদেন আগের চেয়ে একটু সহজ হলো ঠিকই, কিন্তু পুরো স্বাচ্ছন্দ্য এলো না। এর পেছনে ছিল অনেক কারণ। কড়ি, মাছের দাঁত ও পালক ইত্যাদি বহন করা সহজ নয়। আবার একেক দেশে একেকরকম রীতিনীতি বলে এক এলাকার মাধ্যম অন্য এলাকায় অচল।
এমন অবস্থায় মানুষ নতুন করে ভাবতে শুরু করল। আর সেখান থেকেই তাদের মাথায় এল তামা, রুপা ও সোনার মুদ্রা। তামা, রুপা ও সোনা মূল্যবান ধাতু। এগুলোতে সহজেই ছাপ দেওয়া যায়। আবার রোদ, বৃষ্টি ও পানিতে এগুলো নষ্ট হয় না। এগুলো বহন করাও সহজ। সংরক্ষণ করাও কঠিন নয়। এ কারণে শুরু হলো তামার মুদ্রা, রৌপ্য মুদ্রা ও স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন। এক সময় ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবী জুড়ে। ঠিক কবে, কোন দেশে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় তা কিছুটা বিতর্ক আছে। নিশ্চিত করে কেউ করতে পারছে না। তবে জোরালো দুটি মত আছে। এদের এক পক্ষের মতে চীন দেশে প্রথম ধাতব মুদ্রার প্রচলন হয়। অন্য পক্ষের মতে তুরস্কের লিডিয়া নামের একটি দ্বীপে প্রথম চালু হয় এ মুদ্রা। সেটি যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে। তার মানে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। ভারতবর্ষে প্রথমে তামার মুদ্রার প্রচলন হয়। মনে করা হয়, ২ হাজার ৪শ বছর আগে স¤্রাট চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে এ মুদ্রার প্রচলন হয়। তখন ধাতু গলিয়ে পাতলা পাত বানিয়ে সেটি কেটে মুদ্রা বানানো হতো। মুদ্রার উভয় পিঠে থাকতো নানা ধরনের ছাপ। ধাতু গলিয়ে সবাই মুদ্রা বানালে কেউ কারোরটা গ্রহণ করবে না। এ কারণে ছাপ দিয়ে সরকারি মুদ্রা বানানো হতো। যাতে এগুলো নকল করা না যায়।