সমন্বিত উদ্যোগেই সম্ভব খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ
আবুল বাশার
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে বিবদমান শীর্ষ জাতীয় সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে ব্যাংক খাতের ‘খেলাপি ঋণ’। এ সমস্যা অতীতেও ছিল। তবে বর্তমানের অবস্থা নিকট অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। গত পাঁচ বছরে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০১৮ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, যা আমাদের জাতীয় বাজেটের এক-চতুর্থাংশ! ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা, যা পদ্মা সেতুর বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশের সমান। সাধারণত ছয় মাস বা তদূর্ধ্ব মেয়াদে অনাদায়ী থাকা ঋণকেই খেলাপি (ডিফল্টার) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ছয় মাসের কম সময় ধরে অনিয়মিত বা অনাদায়ী ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা (রিটেন অফ), পুনঃতফসিল করা (রিশিডিউলড) ও পুনর্বিন্যাসকৃত (রিস্ট্রাকচার্ড) ঋণের পরিমাণ যোগ করলে এ খাতে খেলাপির আসল চিত্র বিভীষিকাময়ই প্রতীয়মান হবে।
খেলাপি ঋণকে কেবল ব্যাংক খাতের সমস্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা অর্থমন্ত্রীর হাতে সোপর্দ করে দিলেই সমস্যার সুরাহা হবে না। প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে দুদক বড় ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোকেও মানতে হবে যে, নিজের ঘরের সমস্যা পরের ঘরের কেউ সমাধান করে দেবে না। নিজস্ব কিছু উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হতে হবে প্রতিটি ব্যাংককে। ক্লাসিফায়েড, রিটেন অফ, রিশিডিউলড, রিস্ট্রাকচার্ড ও দুর্বল ঋণগুলো চিহ্নিত করে যথাশিগগির প্রধান কার্যালয়ে রিকভারি মনিটরিং কমিটি ও শাখা পর্যায়ে রিকভারি টিম গঠন করে প্রত্যেক নির্বাহী কর্মকর্তাকেই নির্দিষ্ট কিছু অ্যাকাউন্টের ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে নিয়মিত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। প্রধান কার্যালয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের নেতৃত্বে নিয়মিত ক্যাম্পেইন এবং তদারকির পাশাপাশি শাখাগুলোও নিয়মিত আদায় কার্যক্রমের অতিরিক্ত মাসের অন্তত একটি দিন ‘রিকভারি ডে’ পালন করবে। আদায়ে পারদর্শী নির্বাহী ও কর্মকর্তাকে আর্থিক প্রণোদনা ও বিশেষ পদোন্নতির বিধান রাখা যেতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে কুইক হিলের জন্য সীমিত সময়ে ১০ বছরের অধিক সময় ধরে অনাদায়ী ঋণগ্রহীতা যারা এককালীন সব ঋণ পরিশোধ করবেন, তাদের সুদ ও মূল ঋণের একটি অংশ মওকুফের অফার দেওয়া যেতে পারে। সুস্থ ঋণের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুস্থ ও সঠিক ডকুমেন্টেশন, যা ঋণের পক্ষের দলিল ও প্রমাণ। তাই শাখাগুলোয় ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়াকে কমপ্লায়েন্ট করতেই হবে। এজন্য প্রতি বছর বেস্ট ডকুমেন্টেশন কমপ্লায়েন্ট শাখা নির্বাচন করে পুরস্কৃত করার পাশাপাশি ডকুমেন্টেশন নন-কমপ্লায়েন্ট শাখাগুলোকে জরিমানা ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
যে ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের খেলাপি, তাকে অন্য কোনো ব্যাংক আর কোনো ধরনের ব্যাংকিং সেবা ও সুবিধা দিতে পারবে না। এক ব্যাংকে ঋণ অনিয়মিত বা খেলাপি হলে তখন সেই ব্যক্তি অন্য ব্যাংকে ভাব জমানোরও নজির আছে। যে ব্যাংকে খেলাপি, সে ব্যাংকে লেনদেন বন্ধ করে দিয়ে পার্শ্ববর্তী আরেক ব্যাংকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং লেনদেন করতে দেখা যায়। তাই এমন ব্যক্তির ব্যাংকিং সেবায় সব ব্যাংককে একযোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে। যে কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগে গ্রাহকের অন্তত ৫০ শতাংশ মার্জিন নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ষিক ক্রয়ের বা বিক্রয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ পর্যন্ত ঋণ প্রদানের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। ফাঁকা বুলিসমৃদ্ধ অসত্য ও অবাস্তব নেট ওয়ার্থ (দায়ের চেয়ে বেশি সম্পদ বা প্রকৃত সম্পদ) তৈরি না করে প্রমাণযোগ্য সম্পদ ও দায়ের ভিত্তিতে নেট ওয়ার্থ (দায়ের চেয়ে বেশি সম্পদ) তৈরি করতে হবে। তাই দায় জানতে সিআইবি রিপোর্টের পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা ও জামিনদাতা উভয়ের কাছ থেকেই সম্পদের মালিকানা প্রমাণে জমিজমা, ফ্ল্যাট, বাড়ি, স্থাপনা প্রভৃতির মালিকানা দলিল, নামজারি খতিয়ান ও ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রসিদ গ্রহণ করতে হবে। আয়কর বিবরণী, ব্যাংক হিসাবের বিবরণীও বিবেচনায় নিতে হবে। ঋণগ্রহীতা ও জামিনদাতার মোট নেট ওয়ার্থের অর্ধেকের বেশি ঋণ না দেওয়ার বিধান করা যেতে পারে। ৫০ লাখ বা তদূর্ধ্ব অঙ্কের ঋণের জন্য অডিটেড আয় বিবরণী, ব্যালান্স শিট, প্রজেক্ট প্রোফাইল, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল অ্যাসেসমেন্ট বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
খেলাপি সমস্যা ব্যাংক খাতের ক্যানসার। তাই সাধারণ ওষুধে এ রোগ আর সারবে না। এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে একটি সমন্বিত তথা বড়সড় একটি ধাক্কা প্রয়োজন, যা ব্যাংক খাতকে নাড়িয়ে দেবে, জাগিয়ে দেবে। ব্যাংকগুলো যেমন ঝিমিয়ে পড়া আদায় প্রক্রিয়ায় গতি আনতে সময় সময় আদায় ক্যাম্পেইন করে থাকে, এমন মিশন নিয়ে উচ্চ ও নিম্ন আদালতও খেলাপি ঋণের রায় মাস, পুলিশ প্রশাসনও একযোগে সাজাপ্রাপ্ত ও ওয়ারেন্টভুক্ত খেলাপি গ্রেফতার মাস পালন করুক। এতে রাতারাতি দৃশ্যপট পাল্টে না গেলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের দৌরাত্ম্য কমবে। আগের মতো দাপট দেখানোর সাহস পাবে না তারা।