চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের মোট অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকা, মাথাপিছু মোট ঋণ হবে ৪৪,৮৭৭ টাকা বাজেট বাস্তবায়নে প্রতিবছর সরকারের ঋণ বাড়ছে
সোহেল রহমান : ৪) সুদসহ দেনা পরিশোধের পরও বাজেট বাস্তবায়নে প্রতিবছর সার্বিকভাবে সরকারের ঋণ বাড়ছে। মধ্য মেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে সরকারের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ৭ লাখ ৪০ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। দেশের মোট জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি ধরলে চলতি অর্থবছর শেষে মাথাপিছু মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৪ হাজার ৮৭৭ টাকা। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে দেশে মাথাপিছু মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৩৭১ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু ঋণ বাড়ছে ৪ হাজার ৫০৬ টাকা।
৫) মধ্য মেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাজেটের আকার বাড়ছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ছে না। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে চলেছে এবং বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার। বাজেট ঘাটতি পূরণে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ১ লাখ ২৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ঋণ নেয়া হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪১ কোটি টাকা।
(৬) বিশ্লেষকদের মতে, কাঙ্খিত হারে রাজস্ব আদায় না-বাড়া ও সুষ্ঠু ঋণ ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিবছর সরকারের ঋণ বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে দেশের আর্থিক খাত ও সরকারের ওপরে বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হবে।
(৫) তবে সরকারের ঋণের পরিমাণ জিডিপি’র ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উদ্বেগজনক নয় বলে মনে করেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। সরকারি হিসাবে, চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপি’র ২৯ দশমিক ০২ শতাংশ। সংশোধিত হিসাব অনুযায়ী, টাকার অঙ্কে চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি’র মোট আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৫ লাখ ৫১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
(৬) সরকারের ঋণের বোঝা কমিয়ে আনতে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়িয়ে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। প্রসঙ্গত: বর্তমানে দেশে কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ১০ শতাংশ।
(৭) বাজেট ঘাটতি পূরণে অতীতে বৈদেশিক উৎস থেকেই অধিক ঋণ (প্রায় ৬০ শতাংশ) নেয়া হতো। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ কমে যাওয়ায় ও অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর জোর দেয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। বাজেট ঘাটতি পূরণে চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৮৮ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা (জিডিপি’র ৩ দশমিক ২ শতাংশ) এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ৩৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা (জিডিপি’র ১ দশমিক ৮ শতাংশ) ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে (২০১৭-১৮) অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিট ৬৬ হাজার ১৭ কোটি টাকা (জিডিপি’র ২ দশমিক ৯ শতাংশ) এবং বৈদেশিক উৎস থেকে নিট ৪৬ হাজার ২৪ কোটি টাকা (জিডিপি’র ২ দশমিক ১ শতাংশ) ঋণ নেয়া হয়েছিল।
(৮) বিশ্লেষকদের মতে, বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্ন থাকায় সহজ পথে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের দিকে ঝুঁকেছে সরকার। আর অভ্যন্তরীণ উৎস (ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য) থেকে সরকারের ঋণ বাড়ার কারণে সুদ পরিশোধেও ব্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার অনেক কম।
(৯) তবে সরকার সংশ্লিষ্টদের মতে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের ব্যয় বেশি হলেও এই অর্থ দেশেই থাকছে। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার কম হলেও সেটা বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া এতে অনেক শর্ত থাকে এবং পরামর্শক ফি বাবদ অনেক অর্থ ব্যয় হয়।
(১০) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে দেশে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৫২ কোটি ডলার। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা দরে) হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। এছাড়া গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৪ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার। এসব ঋণের ভারিত গড় সুদ হার হচ্ছে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। গড়ে ৮ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের গড় মেয়াদকাল প্রায় ৩১ বছর। বর্তমানে বৈদেশিক ঋণের যে স্থিতি রয়েছে, নতুন ঋণ না নিলে এটি ২০৫৭ সালের মধ্যেই পরিশোধ হয়ে যাবে এবং প্রতিবছর সর্বোচ্চ ১৬০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ঋণ পরিশোধের এই পরিমাণ রফতানি ও রেমিট্যান্সের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মোট রাজস্বের ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। সম্পাদনা : ইকবাল খান