![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/themes/amader-orthoneeti/img/sky.jpg)
দোল ও গৌরপূর্ণিমা
![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/uploads/2019/03/Pranjal-Acharjee-1.jpg)
প্রকৌশলী প্রাঞ্জল আচার্য্য
যে গৌর, সে কৃষ্ণ, সেই জগন্নাথ। দ্বাপরে যিনি শ্রীকৃষ্ণ, কলিতে তিনিই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। স্কন্ধপুরাণে আছে- ‘অন্তঃকৃষ্ণো বর্হিগৌরঃ সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্র পার্ষদঃ। শচী গর্ভে সমাপ�ুয়াৎ মায়া মানুষ কর্মকৃৎ॥’
অর্থাৎ ভগবান অন্তরে কৃষ্ণ এবং শ্রীরাধার অঙ্গকান্তি দ্বারা বাহিরে গৌররূপ ধারণপূর্বক অঙ্গ (শ্রীনিত্যানন্দাদি), উপাঙ্গ (শ্রীঅদ্বৈতাদি), অস্ত্র (হরিনাম) ও পার্ষদ (শ্রীবাসাদি) সহ শচীগর্ভে প্রকটিত হইয়া মায়িক মানুষের ন্যায় কর্ম করিবেন। অর্থাৎ নিজ ঐশ্বর্যভাব গোপন করিবেন।
নিমাই, গোরাচাঁদ, গৌরহরি এই শব্দগুলি শোনামাত্রই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে, যিনি রাধা-কৃষ্ণের যুগল তনু, যিনি কলিযুগের হতভাগ্য জীবদের কৃষ্ণনামের প্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে কলির কলুষ থেকে উদ্ধার করে ভগবদ্ধামে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি আর কেউ নন, তিনি শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু। ৫৩৩ বৎসর পূর্বে অর্থাৎ ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ, ৮৯১ বঙ্গাব্দের ২৩ ফাল্গুন দোলপূর্ণিমার তিথিতে তিনি জন্মগ্রহণ করে দিনটিকে মহিমান্বিত করেছেন।
প্রায় ৫৫০০ বৎসর পূর্বে আজকের দিনে দ্বাপর যুগে যখন ব্রজবাসীরা দোলোৎসব পালন করছিলেন। ফাল্গুনের পূর্ণিমা তিথিতে বৃন্দাবন লীলায় শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারাণীকে একত্রে দর্শন করতে পেরে ব্রজবাসীগণ তাদের ফুলের দোলনায় বসিয়ে মহাআনন্দে দোলাতে থাকেন। সেই আনন্দক্রমেই বহুগুনে বর্ধিত হলে তারা রাধাকৃষ্ণের চরণে বিভিন্ন বর্ণের আবির ঢেলে প্রেমানন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। আর সেইলীলাকে স্মরণ করে আজও আনন্দ উৎসব দোলপূর্ণিমা পালিত হচ্ছে। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ লীলাবিলাস করে জগতের অন্যান্য, জীবদের কথা ভাবলেন- ‘চিরদিন নাহি করি প্রেম ভক্তি দান, ভক্তিবিনা জগতে নাহি অবস্থান।’ (চৈতন্যচরণামৃত)
এছাড়াও সত্যযুগে ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশে ব্রহ্মাজী তাঁর ভক্ত হোলিকাকে বর দেন ‘নিষ্পাপ অবস্থায় কখনোই আগুন তাকে দাহ করবে না।’ ভগবান বিষ্ণুও তাঁর পরমভক্ত প্রহ্লাদকে অত্যাচারী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্ররূপে প্রেরণ করেন। হিরণ্যকশিপু তার শিশুপুত্র প্রহ্লাদকে কয়েকবার হত্যাচেষ্টায় ব্যর্থ হলে বোন হোলিকাকে প্রহ্লাদসহ আগুনে নিক্ষেপ করেন। এমন অন্যায় হতে দেখে বিষ্ণুদেব তাঁর বর ফিরিয়ে নিলে হোলিকা আগুনে ভষ্মীভূত হয়ে যায়। অপরদিকে প্রহ্লাদকে ভগবান বিষ্ণু সম্পূর্ণ অক্ষত দেহেই রক্ষা করেন। অশুভ দানবী হোলিকা নাশ হওয়ার আনন্দেও উৎসবের নাম হোলী উৎসব।
একমাত্র প্রেমভক্তির দ্বারাই গোলক বৃন্দাবন ধামে পরম ভগবানকে লাভ করা যায়। কিন্তু ভগবানতো সহজে প্রেমভক্তি দান করেন না। ভক্তি দুই প্রকার- বৈধীভক্তি এবং রাগানুরাগা ভক্তি। শাস্ত্রবিধি অনুসরণ করে যে ভক্তি করা হয় তাই বৈধীভক্তি। জগতের সকলে বৈধীভক্তির মাধ্যমেই ভগবানের আরাধনা করেন। আর ভগবানকে বৈধীভক্তির মাধ্যমে আরাধনা করলে বৈকুণ্ঠে যাওয়া যায়। কিন্তু বৈকুণ্ঠেরও উপরের লোক গোলক বৃন্দাবনে নয়। আবার ভগবান চাইছেন, সকলেই যেন গোলক বৃন্দাবনে যেতে পারে। আর ভক্তরূপী ভগবানকে বৈধীভক্তির মাধ্যমে আরাধনা করলে গোলক বৃন্দাবনে যাওয়া যায়। তাই কলিযুগে জীবের মুক্তির লক্ষ্যেই পরমেশ^র ভগবান ফাল্গুনের পূর্ণিমা তিথিতে স্বয়ং কৃপা করে ভক্তবেশ ধারণ করে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু রূপে আবির্ভূত হলেন।
বরাহপুরাণ মতে, ‘কলেঃ প্রথমসন্ধ্যায়াং লক্ষ্মীকান্তো ভবিষ্যতি। ব্রহ্মরূপং সমাশ্রিত্য সম্ভবামি যুগে যুগে॥’ অর্থাৎ কলির প্রথম সন্ধ্যায় লক্ষ্মীকান্ত ব্রাহ্মণরূপ আশ্রয় করিয়া আবির্ভূত হইবেন। শ্রীভগবান বললেন- আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই। মদ্ভাগবতে আছে- ‘কৃষ্ণবর্ণংত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গো পাঙ্গাস্ত্র পার্ষদম্। যেজ্ঞৈঃ সংকীর্তন প্রায়ৈ র্র্যজন্তি হিসুমেধসঃ॥ (ভা. ১১/৫/৩২)
ব্রহ্মসংহিতায় আছে- ‘গোবিন্দং আদি পুরুষং’। অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্মা-ের আদি পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর পূর্বে কোনো কিছুই ছিল না। এই কলিযুগে হতভাগ্য জীবদেরকে উদ্ধার করে ভগবদ্ধামে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণই মহাপ্রভু শ্রীচৈতণ্য রূপে আবির্ভূত হয়েছেন তা শাস্ত্রে বহু প্রমাণ আছে।
সৌর পুরাণ মতে, ‘সুপূজিতঃ সদা গৌরঃ কৃষ্ণো বা বেদবিদ্ দ্বিজঃ।’ অর্থাৎ এই শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রই বৈদিক ব্রাহ্মণ হইয়া বা শ্রীগৌরাঙ্গরূপে জগতে সুপূজিত হইবেন।
শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ভক্তবৃন্দকে অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বের ‘সাংখ্যদর্শন’ উপদেশ প্রদান করেছেন। এই তত্ত্বদর্শন অনুযায়ী, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি ও তাঁর সৃষ্টি যুগপৎ এক ও অভিন্ন। ভগবানের পবিত্র নাম কীর্তণের মাধ্যমে মহাপ্রভু এই তত্ত্ব-দর্শন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, ভগবানের পবিত্র নামই হলো ভগবানের শব্দ ব্রহ্মরূপ এবং পূর্ণতত্ত্ব। তাঁর অপ্রাকৃত দিব্যরূপ এক ও অভিন্ন। এভাবে ভগবানের পবিত্র নামকীর্তণের মাধ্যমে- ‘সুখে থাকো, দুখে থাকো, সদা হরিবলে ডাকো।’ এটাই চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা। হরিনামের প্রভাবে জগাই –মাধাই এর মত পাপী যদি উদ্ধার পেয়ে মহানভক্তে পরিণত হতে পারে তবে সাধারণ মানুষের আর কি কথা।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর করুণার সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে, নিজেকে হরিনামের সাগরে অবগাহন করে শুদ্ধ করে তোলা। হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।
লেখক : ভক্তিশাস্ত্রী, মায়াপুর ইনস্টিটিউটস্ অব হায়ার স্টডি, ইসকন, ঢাকা।
![](https://amaderorthoneeti.com/new/wp-content/themes/amader-orthoneeti/img/sky.jpg)