বুদ্ধের চার সিদ্ধান্ত বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি
তহনংকর ভিক্ষু : মানবপুত্র গৌতম বুদ্ধকে কেন্দ্র করে কল্প কাহিনী ও তথাকথিত ইতিহাস অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি। ভারতীয় প্রাচীন পালি ভাষায় বৌদ্ধধর্ম নিয়ে প্রথম লেখা হয় তাও গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বানের বেশ কয়েক’শ বছর পরে।গৌতম বুদ্ধের প্রকৃত ধর্মবাণীকে অনুধাবন করতে হলে বুদ্ধের মূল চার সিদ্ধান্ত জানা দরকার। সিদ্ধান্তগুলো হল-
ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করা
জগতের ¯্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে ঈশ্বরের অস্বিত্ব বুদ্ধ অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর মতেÑজগত সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়মে। জগৎ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রাকৃতি জগতের স্বাভাবিক নিয়ম দ্বারা। ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তাঁর ইচ্ছাতেই যদি মানুষের কাজ-কর্ম নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে খারাপ কাজের জন্য মানুষ কেন দায়ী হবে? মনুষ্য জগতের বাইরের অন্যান্য প্রাণী, যাদের ভাল-খারাপ বিচার-বোধ নেই, তাদের কাজ-কর্মের জন্য ঈশ্বর কীভাবে তাদের দায়ী করবেন। পৃথিবীতে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণ বেশী। তবে কি ঈশ্বর যতটা দয়ালু, তারচেয়ে বেশী নিষ্ঠুর?
ঈশ্বরের জায়গায় বুদ্ধ কার্য-কারণকে দেখতে পেয়েছেন। সমস্তঘটনার পেছনে কার্য-কারণ সম্পর্ক থাকে। বুদ্ধের এই সর্বব্যাপি কার্য-কারণ তত্ত্ব ‘প্রতীত্যসমুৎপাদ’ নামে পরিচিত। কার্য-কারণ সম্পর্ক ছাড়া মানসিক জগতের বা বাইরের জগতের কোনও কিছু ঘটা সম্ভব নয়। আমাদের জীবনে যে দুঃখের ‘প্রতীত্য’ বা ‘প্রাপ্তি ঘটে’ তার পিছনেও আছে ‘সমুদপাদ’ বা ‘উৎপত্তি’র কারণ। কারণ দুটি। এক: তৃষ্ণা, দুই: অবিদ্যা। ইন্দ্রিয়সুখের প্রতিটি তৃষ্ণাই মানুষকে লোভী নিষ্ঠুর হত্যাকারী করে তোলে। দুঃখ মানুষের জীবনে অনিবার্য। দুঃখ যেমন আছে, দুঃখ নিরোধের উপায়ও তেমন-ই আছে। দুঃখ বিনাশের পথ হিসেবে বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গের উপদেশ দিয়েছেন।
আত্মাকে নিত্য স্বীকার না করা
বুদ্ধের মতে এ জগতের সবকিছুই যখন ক্ষণিক ও অনিত্য, তখন কোন স্থায়ী ও শাশ্বত আত্মার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। অনিত্যবাদ তত্ত্বে বুদ্ধ বলেছেন, জগতের সব কিছু নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এ পরিবর্তন প্রকৃতি ও জড় পদার্থের মধ্যে দৃশ্যগোচর হয়। বুদ্ধ এ বিষয়ে আরও অগ্রসর হয়ে বলেছেন, এ পরিবর্তনের নিয়ম প্রাণীর অন্তশরীরেও বিদ্যামান। দেহ ও মন নিয়ে জীব এ নিয়ম শুধু শরীরের উপর কার্যকর, মনের উপর নয়-তা হতে পারে না। এ অবিশ্রান্ত পরিবর্তন নিয়মের উপর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বুদ্ধের অনাত্মাবাদ প্রতিষ্ঠিত। পরিবর্তন যখন প্রকৃতি তথা জগতের ধর্ম, তখন এমন কিছু থাকতে পারে না যা পরিবর্তনশীল নয়। জীবন নাম রুপের সমষ্টি। বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এ চারটি একত্রযোগে নাম এবং পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু এ চার পদার্থের সমন্বয়ে দেহ এবং এই পঞ্চ স্কন্ধের সমষ্টিই জীবন। এর কোনটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকতে পারে না এবং দৃশ্যরুপ ব্যতীত অদৃশ্য নামের অস্তিত্ব থাকাও সম্ভব নয়। শরীরে অবস্থানরত এর অতিরিক্ত কোন স্বতন্ত্র আত্মা থাকতে পারে না। ঘরের ছাদ, দেয়াল, দরজা ইত্যাদিকে নিয়ে যেমন আমরা ঘর নাম দিয়ে থাকি, তেমনি পঞ্চস্কন্ধের মিলনকে আমরা ‘আমি’ বলি। সপ্তবর্ণের একত্র সংযোগে যেমন সাদা রঙের সৃষ্টি করে পঞ্চস্কন্ধের মিলনজাত আত্মাও সেুরুপ।
কোন গ্রন্থকে শ্বাশত বলে স্বীকার না করা
বুদ্ধের অন্যতম প্রধান সিদ্ধান্ত হলÑকোন ধর্মগ্রন্থই স্বতঃপ্রমাণ হতে পারে না। সমস্তদেশে, সমস্তকালের জন্য ধর্মগ্রন্থের কথা ‘সৎ’ বা শাশ্বত হতে পারে না। ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি কথাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার অর্থ কার্য-কারণ সর্ম্পক খোঁজা থেকে বিরত থাকা। ঈশ্বর যখন অস্তিত্বহীন, তখন ঈশ্বরের দৈববাণী নিয়ে বা ঈশ্বরের কথা নিয়ে ধর্মগ্রন্থ গড়ে ঊঠেছে, এমন তত্ত্বকে স্বীকার করা যায় না। কোনও ধর্মগ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ বলে মেনে নেওয়ার অর্থ, ওই গ্রন্থে লেখা কোনও বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কেড়ে নেওয়া। জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে অগ্রগতির যে বিবর্তন আসে, তাকে রোধ করা।
ঐশ্বরিক বা অলৌকিকতা বিশ্বাস না করা কোন ঐশ্বরিক বা অলৌকিকতা থেকে দেবদেবীর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য পূজা অর্চনার বিধিবিধান কিংবা কোনুরুপ অন্ধ বিশ্বাসের স্থান বৌদ্ধ ধর্মে নেই। অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে প্রজ্ঞা সমর্থিত প্রত্যয় বা শ্রদ্ধার কথাই বুদ্ধ বারবার ঘোষণা করেছেন। বুদ্ধের প্রতি তাঁর অনুরাগীদের বিশ্বাস একজন সুচিকিৎসকের প্রতি একজন রোগীর কিংবা একজন শিক্ষকের প্রতি একজন ছাত্রের বিশ্বাসের মতো। নিছক বিশ্বাসের চেয়ে জ্ঞানের মধ্য দিয়ে বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠাই বৌদ্ধ ধর্মের মৌলিক বক্তব্য। এমনকি কোন ঐশ্বরিক শক্তি বা ঈশ্বরের বিশ্বাসও বৌদ্ধ ধর্মে নেই। বুদ্ধের শরণ বা আশ্রয় নেয়ার অর্থ আত্মসমর্পণ নয়, নয় স্বকীয় স্বাধীন চিন্তার খর্বকরণ, মানুষ ইচ্ছে করলে সাধারণ ফলে প্রজ্ঞাশক্তিতে বুদ্ধের সমপর্যায়ে উন্নীত হতে পারে। বৌদ্ধরা কখনো বিশ্বাস করে না যে শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মে আশ্রয় লাভ বা বুদ্ধের প্রতি আস্থা স্থাপনেই আত্মিক পবিত্রতা লাভ করা সম্ভব। বৌদ্ধ বা কারো মনের কলুষ মুক্ত করা বুদ্ধের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। বুদ্ধ নিজেই মানুষকে কলুষতা থেকে মুক্ত করবেন এ রকম নিশ্চয়তা কোনদিন দেননি। বস্তুত কেউ কারো মনের কলুষতা ধুয়ে মুছে দিতে পারে না। বুদ্ধের অমৃতময় বাণীকে অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু কোন ব্যক্তির মানস-শুদ্ধি একান্তভাবেই তার নিজ প্রচেষ্টার উপর নির্ভরশীল। গৌতম বুদ্ধ মানব সন্তান। তিনি ঈশ্বর বা দেবতা নন। নন কোন ঈশ্বর প্রেরিত বা ঈশ্বরের বার্তাবহ পুুরুষ। রাজকুমার সিদ্ধার্থ জরা ব্যাধি মৃত্যু প্রপীড়িত মানুষের দুঃখের মূল উৎপাটন করার জন্যে রাজ সিংহাসন ত্যাগ করে কঠোর তপস্যা ও সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাই তিনি বললেন, স্বার্থ ত্যাগ করে, সর্বভূতে দয়া প্রচার করে অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় করে ফেললে তবে মুক্তি হয়; কোন স্থানে গেলে বা জলে ¯œান করলে বা অগ্নিতে আহুতি দিলে বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে তা হয় না। এভাবে মানুষের মুক্তি মানুষের অন্তরেই নিহিত, বাহ্যিক কোন আচার অনুষ্টানের মধ্যে নয়, কারো নিছক আনুগত্য প্রকাশের মধ্যে নয় এবং প্রার্থনায়ও নয়। স্বীয় আত্মশক্তির উদ্বোধন এবং স্বকীয় প্রেরণার জীবন সম্পর্কে অজ্ঞতা দূরীকরণের প্রচেষ্টার উপর বুদ্ধ জোর দিয়েছেন বেশী। সত্যাসত্য যাছাই ও গ্রহণের প্রতি বুদ্ধের বৈপ্লবিক নির্দেশ নিছক কথিত কোন বিষয় গ্রহণযোগ্য নয়।
সুতরাং বৌদ্ধরা কোন পার্থিব করুণার প্রত্যাশায় কারো পূজা করে না বরং জ্ঞানের প্রতিভূরূপী বুদ্ধকে বা জ্ঞানীকে শ্রদ্ধা জানায় এবং বুদ্ধ গুণাবলী নিজ অন্তরে সঞ্চারিত করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করে। অবশ্য তা বৌদ্ধদের জন্য অপরিহার্য নয়। বুদ্ধিমান মানুষ এ গৌণ ব্যাপার সহজেই বর্জন করতে পারেন।
লেখক : উপাধ্যক্ষ ও নির্বাহী প্রধান নব প-িত বিহার,চট্টগ্রাম।