সমাজ ও অর্থনীতির মধ্যে মেলবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
দুয়ের মধ্যে সম্পর্কটা সুপ্রাচীন , তবে সময়ের বিবর্তনে সম্পর্কের মধ্যে মতান্তর ঘটেছে। হতেই পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা সমাজ পরিবর্তনশীল নিজস্ব গতিতে, অর্থনীতি সমাজের সেই গতিশীলতার নিয়ামক ; উভয়ের মধ্যে পারষ্পরিক প্রতিফলন ঘটবে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় তখন, যখন অর্থনীতির কাছে সমাজ পরিবর্তনের প্রেসক্রিপশন প্রত্যাশা করা হয়, যখন আশা করা হয় সমাজ বিনির্মাণে আদর্শ ও দর্শন সরবরাহ করতে অর্থনীতির করণীয় কি? আবার অর্থনীতি যদি সমাজের সমৃদ্ধি সাধনে লাগসই ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বঞ্চনা বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি হয়। তা কি কেবল শুধু চেয়ে চেয়ে দেখার বিষয়। সমাজের কি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। যদি প্রশ্ন উত্থাপনই না করতে পারলো সমাজ ও অর্থনীতির গতিধারা নিয়ে, সমাজের গন্তব্য নিয়ে, সমাজের স্বার্থকতা নিয়ে তাহলে তো সমাজের উন্নতির প্রচেষ্টা ব্যর্থতার বিবরে চলে যাবে। সমাজ সমাজের মতো কঠিন কর্কশ পথে এগুতে থাকবে আর সুবোধ বালকের মতো অর্থনীতি তাতে সর্বনাশের পথ রচনা করে চলবে, পথ সুগম হবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে চলাচলের। অর্থনীতির সনাতন নীতি ও নিয়মকানুন বেকুব বনে যায় যে সমাজে, সেখানে উন্নতির কোনো কার্যকর গাইড লাইন বা রোডম্যাপ এখন কেন কশ্মিন কালেও কেউ দিতে পারেনি, পারবে বলে মনে হয় না। কখনো কখনো এ ব্যাপারে কথাবার্তা যে ওঠেনি তা নয়, কিন্ত কার্যকরণগত কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যার অবর্তমানে আলোচনাটা যেন সেভাবে রয়েই গেছে।
নিঃসন্দেহে সমাজ আগে, অর্থনীতি পরে। সমাজ একটা বড় ব্যাপার, অর্থনীতি সেখানে নিয়ামক ভূমিকা পালনকারী অনুগামী একটা শরিকমাত্র । সমাজ অর্থনীতিকে আমলে না আনলে সমাজের কিছু একটা যায় আসে না , কিন্তু অর্থনীতি সমাজকে উপেক্ষা করতে পারে না । সমাজই হচ্ছে অর্থনীতির ক্যানভাস, সমাজ ছাড়া অর্থনীতি চলে না , সমাজের জন্য অর্থনীতির ভূমিকা আছে। সমাজ নেই তো শুধু অর্থনীতি কেন অনেক কিছুই নেই। তবে অর্থনীতি সমাজকে নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করে বলেই সমাজ তার অস্তিত্ব, গতিধারা এমনকি মিশন ও ভিশন নির্মানের জন্য অর্থনীতির পথ চেয়ে থাকে। সমাজ এগুচ্ছে না পেছাচ্ছে তা অর্থনীতির চেয়ে আর কে ভালো বলতে পারে? সমাজ সীমাহীন তীরহারা নদীর মতো চলার পথে অর্থনীতি তার তীর বেঁধে দেয় , অর্থনীতি তাকে নিয়ন্ত্রণের উপায় নির্দেশ করে , গতিশীল হতে শলা পরামর্শ প্রেরণা দেয়। সমাজ যেন স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, স্বার্থকতা ফিরে পায় অর্থনীতির গতিশীলতায় । সাহিত্য সমাজকে আরকাইভে ভরে রাখে , তাকে শ্রেণীবিন্যাস থেকে শুরু করে পর্যায় পর্ব পরিচিতি পর্যন্ত নির্মাণ নির্ধারণের কাজও করে। সাহিত্য না থাকলে সমাজ ইতিহাসের বিষয়বস্ত হতে পারতোনা, কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর তার থাকতোনা। চর্যাপদের মধ্যে অঙ্কিত প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার সমাজচিত্র যেমন সমকালীন জীবনযাত্রার ইতিহাসের সংরক্ষক।
সমাজ চলে সমাজের সকলকে নিয়ে, তাদের অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা আদর্শ ও দর্শনকে অবলম্বন করে। এ সবের ব্যত্যয় এর ব্যারোমিটার মনিটর করে অর্থনীতি । সমাজের গতি যুগধর্মকে অবলম্বন করে। পরিবেশ পরিস্থিতি যুগধর্ম এর নিশান বরদার। পরিবেশ আপনাআপনি নির্মিত হয় না। এর পিছনে কাজ করে নানান কার্যকারণ আর সেই কার্যকরণ সৃজিত হয় প্রকৃতির প্রতি মানুষের আচরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের মাত্রা ও মর্জির দ্বারা এবং প্রকৃতির আচরণের বিপরীতে মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সূত্রে। মানুষ প্রকৃতির কোলে প্রতিপালিত হয়, প্রকৃতিকে আত্মন্থ করে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে কিংবা প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মানুষ জীবন যাপনই শুধু করে না সেই জীবনের নানান প্রেক্ষাপট নির্মাণ করে, সহায় সম্পদ সৌধ নির্মাণ করে , রুচি অভিরুচির ক্ষেত্র প্রস্তত করে। এভাবেই প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়ায় বেড়ে ওঠে মানব জীবনের নানান পর্ব। পার্ল এস বাকের গুড আর্থ এ আমরা জীবন আর প্রকৃতির নিরন্তর সংগ্রাম সৌহার্দের যোজনা দেখি। প্রায় শতবর্ষের কাল পরিক্রমার ক্যানভাসে আনন্দ বেদনার কাব্য রচিত হয় চীনা সমাজে তিন পুরুষের সংগ্রাম আর সন্ধির আয়নায় দেখা অসংখ্য ঘটনা ও এর আকর্ষণ বিকর্ষণের বর্ণিল অবয়বে। এখানে নিরন্তর রূপান্তর প্রত্যক্ষ করি উপলদ্ধির, মূল্যবোধের, আচার আচরণের । যুগধর্মের প্রতি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে যেয়ে বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন আচারণে নিষ্ঠ হয়েছে এর বিভিন্ন চরিত্র। সমকালীন সমাজের রুপান্তর আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয় চরিত্রনিচয়ের আবেগ অনুভূতি আর উক্তি ও উপলদ্ভির সালতামামির মাধ্যমে। অর্থনীতির প্রযোজনায় নগরায়ন ও শিল্পবিপ্লব এসেছে , গ্রামীণ জীবন থেকে নাগরিক জীবনে অনুপ্রবেশের অন্তরালে স্মৃতিভান্ডারে যে দোলাচাল সৃষ্টি হয়েছে, চেতনার কার্নিশে জল পড়ে পাতা নড়ের যে অনুরণন সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে পাঠক উপলদ্ধি করে নস্টালজিক নান্দনিকতার। শরৎ চন্দ্রের দেবদাস এ তাল সোনাপুর গ্রামে পার্বতি দেবদাসের আবাল্য কৈশোর ও বয়োসন্ধির আবেগ-উৎকন্ঠাকে শহুরে চুনিলাল চন্দ্রমুখির দগ্ধ জীবনবোধের সাথে কালান্তরে এক অভিনব সমান্তরাল রৈখিক চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে জীবনের সেই নিত্যতাকে নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন লেখক যা মানব জীবনের শাশ্বত সম্পর্কের কাব্যগাথা। তাল সোনাপুর গ্রাম বাংলার হাজার গ্রামের একটি কিন্তু দেবদাস পার্বতির গ্রাম হিসেবে তা হয়েছে স্বনামধন্য। সাহিত্য এভাবে সমাজকে কালান্তরে পৌঁছিয়ে দেয়। নগর আর গ্রামীণ জীবন এর ক্যানভাসে পরিবর্তনের প্রান্তসীমায় মানব সম্পর্কের আটপৌরে অবয়ব, আনন্দ-বেদনার, অভিমান-আক্ষেপের, আভিজাত্য আর আবহমান হৃদবন্ধনপ্রয়াসের ধ্রুপদ সঙ্গীত এখানে শ্রুত হয়।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান