গণহত্যায় ‘অন্তর্ধান’ ব্যক্তির অধিকার
প্রিয়াংকা আচার্য্য : মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যায় বহু পরিবার তাদের স্বজনদের খোঁজ আর কখনও পায়নি। এমনকি হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের মৃতদেহও তাদের কাছে হস্তান্তর করেনি পাকহানাদাররা। দেশের আনাচে-কানাচে এমন নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা অগণিত। বিজ্ঞ গবেষক ড. এম এ হাসান ও মাফিদুল হক গণহত্যা এবং অন্তর্ধান হওয়া ব্যক্তির অধিকার নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরলেন।
ড. এম এ হাসান বলেন, ‘২০০২ সালে যখন আমি আইসিসি, অ্যামেনেস্টি এবং জাতিসংঘের সাথে বিচারহীনতা (ইমপিউনিটি) এবং জোরপূর্বক অন্তর্ধান হওয়া ব্যক্তিদের (এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স) নিয়ে কাজ করছিলাম তখন বেলজিয়ামের আইন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এরিক ডেভিড আমাদের জানালেন, যিনি জোরপূর্বক নিখোঁজ হয়েছেন তার বিচারটি যেকোনো পর্যায়ে চলমান বিষয়। তার অধিকার রয়েছে সুবিচার পাওয়া এবং পরিবারের অধিকার তাকে ফিরে পাওয়া বা তার সন্ধান পাওয়া।’
‘এটি কোনো রেট্রোগেট বিচার না। সাধারণত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের বিচারে কোনো পেছনের ঘটনার বিচার হয় না। কিন্তু এই একটিমাত্র কেসে, দূর অতীতে যদি কেউ নিখোঁজ হয়ে থাকে তার বিচার হতে পারে। ৭১ সালে এই দেশ থেকে নারীসহ যারা জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা মাইগ্রেশনের শিকার হয়েছেন এবং পরবর্তীতে যাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের বিচারটি হতে পারে। কারণ তাদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার অধিকার পুরো পৃথিবীর রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের নানা অলক্ষ্য ইতিহাস এবং অশ্রুত ঘটনা রয়ে গেছে। যা নিয়ে এখনও কাজ হয়নি। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে অন্তর্ধান হওয়া ব্যক্তির অধিকারের বিষয়টি একটি ইউনিভার্সাল রাইট।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি গবেষক মফিদুল হক বলেন, ‘বিশ^জুড়ে যখন সংঘাত হয় তখন অন্তর্ধান হওয়া ব্যক্তিদের (ডিসএ্যাপেয়ার্ড) একটা অধিকার থাকে, যা পরবর্তীতে তাদের পরিবারের উপর বর্তায়। পরিবারের এটা জানার অধিকার থাকে যে, তার স্বজনের শেষ পরিণতিটা কী হয়েছিলো।’
‘দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষে আমরা দেখেছি, অনেক সৈনিকের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাদের সন্ধান অব্যাহত আছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরও অন্তর্ধান হওয়া সৈনিকদের খোঁজ করতে দেখা গেছে দুপক্ষকেই। যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম সরকার মিলিতভাবে নিখোঁজ সৈনিকদের সন্ধান অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, সেখোনে বলপূর্বক যে সকল লোক অন্তর্ধান হয়েছেন তাদের হদিস করার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি এখনও আমরা সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।’
‘জাতিসংঘের উদ্যোগে অন্তর্ধান হওয়ার ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় আলাদা কমিশন গঠন হয়েছে। আন্তর্জাতিক নানা সংস্থাও এ বিষয়ে কাজ করছে। নানা দেশে সংঘটিত গণহত্যার পর অন্তর্ধান হওয়ার ব্যক্তির সন্ধানে সংগঠনগুলো কাজও করে যাচ্ছে।’
‘বাংলাদেশের লাখো মানুষের পরিবার-পরিজন আজও জানতে পারেনি তাদের স্বজনের শেষ পরিণতির কথা। শহীদ রুমি বা শহীদ আলতাফ মাহমুদসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর কথা জানি যাদের হদিস আর কখনই মেলেনি। এ কাজটি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের একটি অসমাপ্ত দায়িত্ব।’
প্রসঙ্গত, ‘গণহত্যা’ বা ‘এবহড়পরফব’ শব্দটি এখন বিশেষ টার্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শুধু একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা (গধংং শরষষরহম) করলে সেটি গণহত্যা বোঝায় না। ১৯৪৮’র ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশন ২৬০ (৩) এর অধীনে গণহত্যা বলতে বোঝায় এমন নিধনযজ্ঞÑ যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে যদি একজনকেও হত্যা করা হয় তাহলেও তা গণহত্যা বলে বিবেচিত হবে। গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় যা বিশ্বময় প্রতিরোধে সকল রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালী নিধনে পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালিত হয়। কোনো দেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এমন নৃশংসতম গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার-আলবদরা-আলশামস্রা সারাদেশে গণহত্যা চালায় গোটা ৯ মাস। যাতে নিহত হয় ৩০ লাখ মানুষ ও সম্ভ্রম হারায় ৪ লাখ নারী।
কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বল্পসময়ে এতো বিপুলসংখ্যক লোকের আত্মত্যাগের ঘটনা আর নেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। ফলে আজও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি জোরালোভাবে উঠেনি।
মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার দাবি তোলার পর ২০১৭ সাল থেকে দেশে এখন জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে।