অর্থনীতিবিদদের ভাবনায় উন্নয়নের সংজ্ঞা
ফখরুল মজুমদার
উন্নয়নের একটি গ্রহণীয় সংজ্ঞা নির্ধারণ খুবই কঠিন। এটা আজ পর্যন্ত নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ এক এক তাত্তি¡ক এক এক ধরনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন, অর্থনীতিবিদরা সব সময়ই উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে অর্থনীতিকে টেনে এনেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে সমাজের উন্নয়নকে জোর দিয়েছেন। মনোবিজ্ঞানীরা উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে মানুষের মন-মানসিকতার উন্নয়নকে জোর দিয়েছেন। প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা উন্নয়নের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ওপর জোর দিয়েছেন। নৃ-বিজ্ঞানীরা উন্নয়নের সংজ্ঞার মধ্যে সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে দেখা যায়, কেউই উন্নয়নের সর্বজনীন ও গ্রহণীয় সংজ্ঞা দিতে পারেননি। প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট সমাজ বা দেশের প্রেক্ষাপটে উন্নয়নের সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এখন দেখা যাক বিভিন্ন তাত্তি¡কের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নের অতীত ও বর্তমানের সংজ্ঞা, যা উন্নয়নের গ্রহণীয় সংজ্ঞা সম্পর্কিত ধারণাকে আরো ত্বরান্বিত করবে।
অর্থনীতিবিদরা উন্নয়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, উন্নয়ন হলো কোনো দেশ বা সমাজে যদি মুক্ত অর্থনীতির কাঠামো বিরাজমান থাকে তবেই ওই দেশের উন্নয়ন সম্ভব। কারণ তারা মনে করেন, এ অবস্থা সমাজ বা দেশে বিরাজমান থাকলে ব্যক্তিস্বার্থ উন্নয়নে সবাই আগ্রহী হবেন। আর এ জন্য সমষ্টিগত স্বাথের উন্নয়ন তথা জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব হয়ে উঠবে। মার্কসবাদীরা বলেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোর উপনিবেশ দূর করতে পারলে এবং সুষম বণ্টন করতে পারলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যে পরিবর্তন সংঘটিত হবে তা-ই উন্নয়ন। পশ্চিমা দেশগুলোর পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থা পুনর্গঠন করে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হলেই উন্নয়ন সম্ভব। আবার পুঁজিবাদীরা বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই হলো উন্নয়ন, যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার স্থান এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যক্তিমালিকানায় রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে উন্নয়ন করার কথা বলা হয়েছে। উন্নয়নের এসব সংজ্ঞা তাত্তি¡কদের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণরুপে গ্রহণযোগ্য নয়। লব্ধ ও অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে উন্নয়নের গ্রহণীয় সংজ্ঞা হতে পারে।
‘উন্নয়ন’ শব্দের অর্থ হলো উন্নতি হতে যাচ্ছে এমন অর্থাৎ উন্নয়ন হলো পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া, যা বস্তুগত ও মানসিক উভয় ব্যাপার। কোনো সমাজ বা দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিক, চিন্তাগত ও সাংস্কৃতিক অবস্থা ইত্যাদির পরিবর্তন (উন্নতি) হওয়াই হলো উন্নয়ন। এসব বিষয়ের সুসংগঠিত কাঠামো গঠনপূর্বক উৎপাদনমুখী প্রযুক্তি ব্যবহার, শ্রম, মেধা ও পুঁজির সঠিক প্রয়োগসংবলিত ব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত সুফল সমাজ বা দেশের জনগণের চিন্তাচেতনায় যৌক্তিকভাবে নিবেদন করলে জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক যে উন্নতি সাধন হয় তা-ই হলো উন্নয়ন। এ উন্নয়ন প্রত্যয়টি শুধু ঊপড়হড়সরপ নয় বরং ঐঁসধহ ঢ়ৎড়নষবস-ও বটে। উন্নয়নের সঙ্গে যেমন সমাজ ও মানুষ জড়িত, তেমনি ঘড়হ-বপড়হড়সরপ ঋধপঃড়ৎ-ও সম্পৃক্ত। অর্থাৎ উন্নয়ন শুধু পরিমাণগত, পরিমাপগত ও সাংখ্যিক উন্নতি নয় বরং ঠধষঁবং, ঞৎধফরঃরড়হ, অৎঃং, ঢ়ৎড়নষবস এবং ঈঁষঃঁৎব ইত্যাদি বিষয়ও উন্নয়ন প্রত্যেয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অতএব আমরা বলতে পারি উন্নয়ন হলো কোনো সমাজ বা দেশের নাগরিকদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত সামগ্রিক বিষয়ের উন্নতি সাধন, যেখানে সব বিষয় সমান গুরুত্ব পায়।
উন্নয়নের মূল বিষয় হলোÑ ‘সমাজে এমন পরিবর্তন সাধিত হবে যাতে জনগণ ক্রমান্বয়ে ব্যাপক পরিধিতে সুযোগ-সুবিধা এবং পছন্দ-অপছন্দের স্বাধীনতা পাবে ও স্বনির্ভর হবে।’ আমার দৃষ্টিতে উন্নয়ন-সম্পর্কিত উল্লিখিত বক্তব্যই হলো উন্নয়নের গ্রহণীয় সংজ্ঞা, যা অনেকের মতের সঙ্গে হয়তো অভিন্ন হবে। প্রকৃত অর্থেই উন্নয়ন বিষয়টি ব্যাপক। উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতগুলো শর্ত রয়েছে। যেমন- (১) সমস্ত জমি উৎপাদনে ব্যবহারযোগ্য, (২) কৃষি কাঠামো উৎপাদনমুখী, (৩) ভ‚মির সরবরাহ সীমাবদ্ধ, (৪) শ্রম ও পুঁজির পরিবর্তনশীলতা, শ্রমশক্তির সঠিক ব্যবহার এবং শ্রম সরবরাহ মূল্য স্থিতিশীল, (৫) প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রসার ও প্রয়োগ, (৬) জনসংখ্যা ও সম্পদের ভারসাম্য, (৭) শিক্ষার বিস্তার, (৮) অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সৃষ্টি, (৯) বাজার পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক, (১০) প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার, (১১) জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, (১২) সুসংহত সমাজব্যবস্থা, (১৩) শিল্পের উন্নতি সাধন ও মূলধন গঠন, (১৪) বিদেশের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস এবং (১৫) বিশ্বায়নের সঙ্গে যৌক্তিক সমন্বয়।
আবার মাথাপিছু আয়, জাতীয় আয়, সব ধরনের অর্থনৈতিক প্যারামিটারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এবং কতটুকু সঞ্চয় হচ্ছে ইত্যাদি হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি। আর উল্লিখিত বিষয়ের ক্রমোন্নতিই হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। যেমন, কোনো দেশের মাথাপিছু আয় ৫ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত হওয়া হলো ওই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আবার দেশের জনগণের মানসিকতার ওপর উন্নয়ন নির্ভর করে। যদি দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে জনগণ সচেতন থাকে তবেও উন্নয়ন সম্ভব হবে। কারণ ‘সীমিত সম্পদে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা’Ñ এতে উন্নয়ন হবে না।
প্রসঙ্গত, ‘ঐতিহ্যবন্ধন কৃষক মডেল’ অনুসারে তৃতীয় বিশ্বের গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক আচরণ ঐতিহ্য দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের সামাজিক ব্যবস্থা উত্তরাধিকারগতভাবে স্থিতিশীল। স্বদেশীয় যেসব প্রতিষ্ঠান ও চর্চা (চৎধপঃরপব) উন্নয়নের বা আধুনিকীকরণের পথে প্রতিবন্ধক সেগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মাধ্যমেই কেবল উন্নয়ন কর্মকা- চলতে পারে অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ও চর্চার পরিবর্তন সাধন উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। উন্নয়ন প্রত্যেয়টি মূলত একটি দেশ বা একটি সমাজের সঙ্গে যুক্ত। কারণ কোনো অনুন্নত দেশ বা সমাজকে উন্নত করার জন্যই উন্নয়নের ধারা বা পথ অবলম্বন করতে হয়। ফলে উন্নয়ন ধারণাটি গতিশীল ও পরিবর্তনশীল বলা যায়। আর এজন্যই বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের অর্থ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশিত ও গৃহীত হয়েছে।