নারী চা- শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল
আবুল বাশার
কী ধরনের পরিবেশে দেশের চা শ্রমিকদের কাজ করতে হয়, তা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ‘অ্যা স্টাডি রিপোর্ট অন ওয়ার্কিং কন্ডিশনস অব টি প্রেজেন্টেশন ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের চা-শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। চা শ্রমিকদের ৬৩ শতাংশই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। দেশের ১০টি চা বাগানের ২৯৭ শ্রমিকের তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করলেও ঝড়-বৃষ্টিতে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই কর্মক্ষেত্রের পাশে। সেভাবে বিশ্রামও পান না শ্রমিকরা। অভাব রয়েছে নিরাপত্তা কিটস, টয়লেট সুবিধারও। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্য না পাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে চা শ্রমিকদের মধ্যে। স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ৭৫ শতাংশের বেশি চা শ্রমিকের। ৮৪ শতাংশ শ্রমিক ভোগেন মাথাব্যথায়। মাংসপেশির ব্যথা নিয়ে কাজ করেন ৭৪ শতাংশ শ্রমিক। আর পিঠের ব্যথায় আক্রান্তদের ৭২ শতাংশ এসব রোগে ভুগলেও চা শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা সুবিধা বেশ দুর্বল। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চা শ্রমিকরা প্রতিদিন গড়ে ৮৫ টাকা মজুরি প্রাপ্য হলেও পাচ্ছেন গড়ে ৬৯ টাকা। দেশের এ মজুরি হার ভারতের চেয়েও অনেক কম। নির্দিষ্ট ওজনের মধ্যেই চা তুলতে পারলে কেবল ৮৫ টাকা পেয়ে থাকেন। এর চেয়ে কম তুললে হাজিরা থেকে কাটা পড়ে নির্দিষ্ট হারে। ৫৫ শতাংশ চা শ্রমিকের মাসিক আয় এক হাজার ৫০১ টাকা। অন্যদিকে ৩৩ শতাংশ শ্রমিকের আয় এক হাজার ৫০০ টাকা। তিন হাজার টাকা আয় করেন মাত্র দুই শতাংশ চা শ্রমিক। নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তারা। কেননা, ৯৩ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ পাচ্ছেন। চা শ্রমিকদের ৬৪ শতাংশই নারী। গবেষণার তথ্যমতে, ৯০ শতাংশ চা শ্রমিকই তাদের সুপারভাইজার কর্তৃক হয়রানির শিকার হন।
বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত চা শ্রমিকরা। ৮৫ টাকা মজুরিতে কারও পক্ষেই সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মালিকরা অনেক বেশি লাভবান হলেও শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে দিনের পর দিন। সময়োপযোগী ও বাজারদরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সবার সম্মতিক্রমে চা শ্রমিকদের জন্য একটি মজুরি নির্ধারণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।
চা শ্রমিকদের আবাসও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৯১ শতাংশ শ্রমিক মালিকের দেওয়া ব্যবস্থাপনায় থাকলেও তাদের আবাসস্থলের আকার, সুযোগ-সুবিধা, পরিমাণ ও জায়গা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন ৫৬ শতাংশ শ্রমিক। কয়েকজন নারী শ্রমিক জানান, ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিনই রোদ-বৃষ্টিতে চা বাগানের টিলাগুলোর জঙ্গল ও ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখতে গিয়ে তারা নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন। কিন্তু বাগানে ভালো চিকিৎসা ও ওষুধ না থাকায় তারা রোগাক্রান্ত হয়েও কাজ চালিয়ে যান। কারণ হিসেবে তারা জানান, যা মজুরি পান, তা দিয়ে পরিবারের দু’বেলা খাবারের নিশ্চয়তা থাকে না। আর্থিক এ টানাপড়েনের মধ্যে বাগানের বাইরে গিয়ে কীভাবে নেবেন চিকিৎসাসেবা। তাই নানা রোগবালাই তাদের চিবিয়ে খাচ্ছে।
চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত্যন্ত নি¤œমানের উল্লেখ করে এক চা শ্রমিক নেতা বলেন, অধিকাংশ চা বাগানের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীদের জন্য বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন অসুস্থ চা শ্রমিক সিকলিস্টে নাম লেখাতে দীর্ঘ সময় ধরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বারান্দায় অপেক্ষা করতে হয়। রোগীদের জন্য স্যালাইন, নাপা, হিসটাসিন, প্যারাসিটামল, ম্যাট্রিল ছাড়া এখানে আর কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যানুসারে, দেশে এখন চা বাগানের সংখ্যা ১৬৪টি, যেখানে এক লাখ ১৫ হাজার ৭৫৭ হেক্টর জমিতে চা আবাদ করা হয়। এসব বাগানে নিবন্ধিত চা শ্রমিকের সংখ্যা ৮৯ হাজার ৮১২ জন। কিন্তু পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে চা-শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী প্রায় ১২ লাখ, যার সিংহভাগই ক্ষুন্দ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। সাঁওতাল, ওঁরাও, মোন্ডা, দেশওয়ারী, মোরা, উড়িয়া, খাড়িয়া, রাজবংশী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের চা শ্রমিক। কয়েক বছর ধরেই ছয় থেকে সাড়ে ছয় কোটি কেজি চা উৎপাদন করছেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা। বিশ্ববাজারে প্রায় দুই শতাংশ চায়ের অংশীদার বাংলাদেশ, তারপরও চা শ্রমিকরা থাকছেন বঞ্চিত। এমনকি চা বাগানগুলোয় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী শিশুর অর্ধেকই রয়েছে শিক্ষার বাইরে।
পরিশেষে বলা যায়, দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় চা শ্রমিকরা সব দিক থেকেই অনেক পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ নিরক্ষরতা। দেশে বাজেটের বিরাট অংশ যেখানে ব্যয় হচ্ছে শিক্ষা খাতে, সেখানে চা শ্রমিকদের শিক্ষার হার অতিনগণ্য। দেশের অন্যান্য পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন কোটা সুবিধা রয়েছে, চা শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য তেমন কিছুই নেই। রোদ-বৃষ্টি, ঝড়তুফানÑসবকিছু মাথায় নিয়েই চা বাগানে কাজ করতে হয় তাদের। বৃষ্টি বা ঝড়ের সময় সামান্যতম আশ্রয়ের জন্যও নেই কোনো শ্রমিক ছাউনি। চা বাগানগুলোয় নারী শ্রমিক বা তাদের পরিবারের জন্য থাকে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা। শিক্ষা, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানীয়জল, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা, বসবাসের জন্য উপযোগী বাসস্থানসহ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাগান কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে চা শ্রমিকদের জন্য শ্রম আইনে উল্লেখ করা এসবের কোনো কার্যকারিতা প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন বাড়াতে হলে শ্রমিকদের দিকে নজর দেওয়া সবার আগে জরুরি। আর মানবাধিকারের প্রশ্নে তাদের অধিকার লঙ্ঘন করা তো রীতিমতো দন্ডনীয় অপরাধ; অমানবিকতা তো বটেই।