পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোই বাজারে অসম বণ্টনের মূল কারণ
আবুল বাশার
বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামো হলো পুঁজিবাদ। গত শতকের ৯০’র দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের সাথে সাথে সমাজতন্ত্রের ভাগ্য মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে যায়। পুঁজিবাদ তখন থেকেই সর্বেসর্বা। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই কাঠামো ধারণ করলেও এর রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। পুঁজিবাদের কারণে সংস্কৃতি বিনষ্ট হচ্ছে, মানুষের মানবিক গুণাবলী ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, গুটিকয়েকের মাঝে সমস্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, আরো অসংখ্য সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আসলেই কি তা-ই? যদি পুঁজিবাদ এসব সমস্যার নিয়ামক হয়ও, তাহলে কীভাবে? চলুন জানা যাক।
পুঁজিবাদের উদ্ভব : পুঁজিবাদের বীজ রোপিত হয়েছিল ইউরোপে ‘বø্যাক ডেথ’ নামক মধ্যযুগের সেই ভয়াবহ মহামারী থেকেই। ১৬ শতকের সেই মহামারীতে প্রাণ হারিয়েছিল ইউরোপের ৬০ ভাগের অধিক মানুষ! এর পর থেকে ইউরোপের চেহারাই বদলে যায়। সমাজ, সংস্কৃতির সাথে অর্থনৈতিক কাঠামোও বদলে যায়। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়াদের একটা ছোট্ট অংশ হঠাৎ পরিবর্তিত সমাজ কাঠামোয় ক্ষমতাধর হয়ে উঠলো। তারা দেশের বাইরেও নিজেদের বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে শুরু করলো। সামন্ত সমাজের পতন ঘটলো আর ব্যবসায়ী ও বণিকদের হাত ধরে এলো উপনিবেশবাদ, দাসত্ব আর সা¤্রাজ্যবাদ। ১৮ শতক শুরু হতে হতে ইংল্যান্ডে শিল্পায়ন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। কৃষি, স্থানীয় বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি ছেড়ে ধোঁয়া ওঠা চিমনী, কয়লার গাড়ি, গরম বাষ্প নিঃসরণ করা টেক্সটাইল মিল, বড় বড় রাসায়নিক কারখানা, এসবই হয়ে ওঠে শিল্পায়িত ইংল্যান্ডের চিত্র। এ চিত্র ছিল পুঁজিবাদের প্রাথমিক স্কেচ।
সম্পদের অসম বণ্টন : পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বের গুটিকতক ধনী পুঁজিপতির জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতোই। ২০০০ সালেও পৃথিবীতে বিলিয়ন ডলার অর্থের মালিক ছিলেন কেবল ৩২২ জন। ২০১৫ সালে সে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছিল ১৮২৬ জনে! তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২,৭৫৪-তে! মাত্র ৬৭ জন ব্যক্তি বিশ্বের অর্ধেক সম্পদের মালিক। পুঁজিবাদ যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে ২১০০ সাল আসতে আসতে ১১ জন ‘ট্রিলিয়নেয়ার’ পাবে পৃথিবী! পুঁজিবাদ সৃষ্ট এ বৈষম্যই সকল সামাজিক ব্যাধির কারণ। বৈষম্যই ক্ষুধা, যুদ্ধ, বিদ্রোহ উসকে দেয়।
১. অসমতা : পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাই হলো অসাম্য। এটি এমন এক ব্যবস্থা, যা ধনীকে অবশ্যম্ভাবীভাবে আরো ধনী আর গরীবকে আরো গরীব করে তুলবে। সম্পদের প্রবাহ এখানে একমুখী হতে বাধ্য। এ ব্যবস্থায় একজন ধনী পুঁজিপতি মৃত্যুকালে তার সম্পদ উত্তরাধিকারীদের কাছে সহজে প্রেরণ করে যেতে পারেন।
২. অস্থিতিশীলতা : পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেকাংশেই শেয়ারবাজার, বন্ড, মুদ্রাবাজারের মতো অর্থবাজারের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতার কারণে এ বাজারব্যবস্থা অনেকাংশে অস্থিতিশীল। কেননা, শেয়ার বাজার বা মুদ্রাবাজার যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে নিম্নমুখী হতে পারে এবং কখনো কখনো বড় রকমের ধ্বসও নামতে দেখা যায়। তখন সে ধ্বসের প্রভাব পড়ে সমপ্র অর্থনীতিতে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমে যায়, বেড়ে যায় বেকারত্বের হার আর সার্বিকভাবে পড়ে যায় জীবনযাত্রার মান। বিশ্ব এরকম অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছিল ১৯৩০ সালে। এরপরেও আরও বেশকিছু ছোটখাট অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে বিশ্ব।
৩. একচেটিয়াত্ব : পুঁজিবাদে বাজারে পুঁজির অসমতার কথা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। বাজারের সূচনালগ্নে দেখা গেল, বেশ কয়েকজন ছোট পরিসরের উদ্যোক্তার সাথে প্রতিযোগিতায় নামলো উত্তরাধিকারসূত্রে ব্যাপক পুঁজি লাভ করা কোনো এক উদ্যোক্তা। ফলাফল অনুমেয়। বড় পুঁজির উদ্যোক্তার বিপরীতে টিকতে না পেরে দ্রæত বাজার ত্যাগ করবে ছোট পুঁজির উদ্যোক্তারা। ফলে ঐ নির্দিষ্ট পণ্যের বাজারে একচেটিয়াত্ব কায়েম হবে। আর একচেটিয়া বাজার ক্রেতাদের অসহায় করে তোলে। কেননা, একচেটিয়া বাজারের উৎপাদক নিজের মর্জিমাফিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি করতে পারেন। কিন্তু হাতে কোনো বিকল্প না থাকায় ক্রেতারা সে পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য থাকে।
৪. মনোপসনি : মনোপসনি হচ্ছে মনোপলি বা একচেটিয়াত্বের অনুরূপ একটি ধারণা। একচেটিয়া বাজারে একজন বিক্রেতা, একাধিক ক্রেতা থাকে। মনোপসনি বাজারে একজন ক্রেতা, একাধিক বিক্রেতা থাকে। এই ধারণাটি সাধারণত শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কোনো ফার্ম যখন মনোপসনি ক্ষমতা অর্জন করে, তখন সে বাজারের বিভিন্ন নিয়ামক নিজের ইচ্ছায় পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।
৫. বেকারত্ব : পুঁজিবাদের একটি প্রধানতম সমস্যা বেকারত্ব। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উৎপাদনযন্ত্রের মালিককে অসীম মুনাফার অনুমতি দেয়। ফলে মালিক যেকোনো সময়, যেকোনো পরিস্থিতিতে তার ফার্ম থেকে শ্রমিক ছাঁটাই করে দিতে পারেন। তাছাড়া প্রযুক্তির উৎকর্ষ তো আছেই। বেকারত্বের জন্য যদিও প্রযুক্তিকে দায়ী করা যৌক্তিক হবে না।
৬. পরিবেশ দূষণ : পুঁজিবাদী কাঠামোতে সমাজ ভোগবাদী হওয়ায় এবং সমাজের যাবতীয় উৎপাদিত দ্রব্য পণ্যে রূপান্তরিত হওয়ায় মুনাফাই এখানে প্রথম কথা। ফলে মুনাফার্জনের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে অধিক উৎপাদন করা হচ্ছে যা মোট প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ দ্রæত হ্রাস করছে, পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, বাধাপ্রস্ত করছে টেকসই উন্নয়নকে।